স্থবির

লেখক: রীনা গুলশানারা Category: ছোট গল্প (Short Story) Edition: Dhaboman - Fall 2018

বেশ অনেক্ষন থেকে ও বসে আছে। কতক্ষন ও নিজেই জানে না। স্তব্ধ , অসাড় হয়ে বসে আছে। মনে হচ্ছে শরীরে কোন স্পন্দন নাই। ওকি তবে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে ? নাকি আসলে মারা যাচ্ছে ? হাতে একটা চিঠি এলোমেলো ভাবে ধরা। আসলে এই মুহূর্তে ওর মস্তিস্ক কাজ করছে না। না ও একদম দুঃখে ভারাক্রান্ত নয়। কাঁদতেও পারছে না। কেমন জানি এক অজানিত অনুভূতি। এমনটা যে হবে ওকি জানতো না ? অনেক দিন ধরে একটু একটু বোধগম্য কি হচ্ছিলো না ? তবু আজ কেনো তার এই অনুভূতি ? কেন তার বারবার মনে হচ্ছে, গোটা ব্যাপারটাই অলিক। দুঃস্বপ্ন! কেন মনে হচ্ছে , সে যা কিছু এই চিঠিতে পড়েছে, তার সবটাই মিথ্যা ?  

- কি রে অহনা , বাড়ী যাবি না ? সবাই চলে গেছে। চল জলদি চল।

- হু ! চল।

ওরা একসাথেই রোজ বাড়ী যায়। বহুদিন ধরে। ওরা ক্লাস মেট নয়।বরং নিতু ওর তিন-চার বছরের ছোটই হবে। তবু একসাথে এক পাড়ায় থাকে। আবার একই অফিসে কাজ ও করছে ৭/৮ বছর ধরে । যদিও অহনা, নিতুর ৩/৪ বছরের সিনিয়র এই অফিসে। আর ওদের একই পাড়ায় বাড়ী। অহনাদের ৪/৫ টা বাড়ীর পরেই নিতুদের বাড়ী। একই স্কুলে পড়েছে ওরা ।পল্লীমোঙ্গল স্কুলে। আবার অহনা যখন বাংলায় অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে , তখন নিতুও এসে এইচ এস সি তে ভর্তী হল। ওদের তখন সেমিষ্টার সিস্টেম ছিলো না । সেশন জটে অহনা তখনো সেকেন্ড ইয়ারেই ঝুলে আছে।ইতিমধ্যে নিতু ইন্টারমিডিয়েট পাস করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্সে ভর্তী হলো। তখন থেকেই ধরতে গেলে ওরা এক সাথে বাড়ী যেতো। মাঝেমধ্যে অবশ্য দুজনের ক্লাশের তারতম্য হয়ে যেতো । তখন অবশ্য দুজন আলাদা চলে যেতো । বি এল কলেজিয়েট বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ওরা পাস করেছিল। পরে অবশ্য বি এল থেকে এইচ এস সি উঠে গেলো।সেই থেকেই ওদের দুজনের মধ্যে বয়সের যে ফারাক, সেটা কখন জানি উঠে গেল, সেটা ওরা নিজেরাই জানে না । আপনি থেকে তুমি, তারপর একসময় তুইতে নেমে এলো । অহনা যথেষ্ট চাঁপা স্বভাবের। আর নিতু ঠিক তার উল্টো । বেশ প্রগলভ। ওর এক ফুপাতো ভায়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। ওরা খুবই ঘনিষ্টও ছিলো। সব কিছুই সে অকপটে বলতো অহনাকে। অহনা তাকে বেশ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু নিতুর প্রেম একদম বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মতো । নিতু সত্যিই তার কাজিন জসিমকে প্রান্ দিয়ে ভালোবাসতো । তাইতো ওরা এদিক সেদিক লুকিয়ে চুরিয়ে দেখা করতো । কিন্তু কি জানি কেন অহনার ভয় করতো  ওই সহজ সরল মেয়েটার জন্য ।

একদিন হঠাৎ এসে বললো - জানিস একটা ঘটনা ঘটে গেছে।

- ঘটনাতো বুঝলাম , কাল যে বড় কলেজে এলি না ?

- আরে সেটাইতো ঘটনা !

- কি হলো আবার ? জসিম বিষয়ক মনে হচ্ছে ?

- হু ! ঠিক ধরেছিস... আসলে বেশ কিছুদিন ধরেই আমাদের দুই পরিবারে সব জেনে ফেলেছিলো। তো , আমাদের পরিবারে কোন আপত্তি ছিলো না । কিন্তু আমার ফুপুই এই সম্পর্কের বাঁধ সাধছে।

- বলিস কি ?

- হ্যারে তাই। আমার বাবা একজন সরকারী দপ্তরের কেরানী। আর ফুপা মস্ত বড় ব্যবসায়ী।তাই ফুপু রাজী নয়।

- আশ্চর্য তো ? নিজের ভায়ের সাথে হিংসা ?

- হু ! সেটাই ! গরীব হলে অনেক জ্বালা রে !

- তারপর ?

- তারপর আরকি ? জানিসতো জসিম গতবছর রুয়েট থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছে। তবে ও জার্মানে এম এস করার একটা স্কলারশীপের চেষ্টা করছিলো বেশ কিছুদিন ধরে। তো গত সপ্তাহে সেটার কনফারমেশন লেটার এসেছে।

- ওহ তাই ? এটা দারুন খবর।

- হু ! তাই জসিম আমাকে আগেই বলে রেখেছিলো। গতকাল আমরা বিয়ে করে ফেলেছিরে !

- কি বলছিস এসব ? আর ইউ সিউর ?

- হ্যা রে সব জসিমের প্ল্যান।

- কোথায় কিভাবে কি করলি ? মাগো তুইতো সেই মেঘ না চাইতেই জল এনে ফেললি।

- উপায় ছিলোও না । ওতো সামনের সপ্তাহেই জার্মানে চলে যাচ্ছে।তাই বাধ্য হলাম  বিয়ে করতে ।

- ওমা ! এখন কি হবে রে ? দুই বাড়ীতে জেনে গেলে কি যে হ্যাপা হবে বুঝবি তখন ?

- আরে সেই জন্যইতো জসিম এটা করেছে। সে একেবারে ওর প্রিয় দুই বন্ধুকে নিয়েই এসেছিলো ঢাকা থেকে। একজন আবার আমাদের কমন আত্মীয়ও হিমেল ভাই। আর একজন ওর ক্লাস মেট অরূন। এরা সাক্ষী হয়েছে। ১লাখ টাকা কাবিন নামা । আমাকে এই আংটি টা দিয়েছে, টোপাজের।

- বাড়ীতে কি বলবি ?

- অলরেডী বলেছি , আমার কিছু জমানো টাকা দিয়ে কিনেছি। তারপর একসাথে স্টুডিওতে ছবি তুলেছি। ডীলাক্স হোটেলে লাঞ্চ করেছি।

এরপর মুখ লাল করে বল্লো ,বাসর রাতও যাপন করেছি।

- ওমা ,বলে কি মেয়ে ...কোথায় ?

- ওই হোটেল ডিলাক্সেই জসিম দুইটা রুম নিয়েছিলো ।

- তারপর বাসায় কি বললি ?

- আমি বাসা থেকে বের হবার আগেই বলে গিয়েছিলাম ,শিখাদের বাসায় যাচ্ছি , ওর জন্মদিন। আজ রাতে ওর বাসায় থাকবো। ব্যাস ... বলেই নিতু মুখ লাল করে হাসছিল। হোটেল থেকে ডাইরেক্ট এই কলেজে এলাম। আর ওরাও ঢাকায় চলে গেলো । বলেছে জার্মান যাবার আগে আর একবার এসে দুই দিন থাকবে।

- তখন কি করবি ?

- শিখাকে আগেই বলে রেখেছি। যেদিন জসিম আসবে , শিখা আমাকে এসে নিয়ে যাবে আমার বাসা থেকে , বলবে, নিতু দু দিন আমাদের বাসায় 

থাকবে।

- তোর কি সাহস , বাব্বা ! আমার ভাবতেই ...

বলতে বলতে অহনাও খিল খিল করে হেসে ফেললো ! আর আমি ওর সাথে দেখা করতেও ভয়ে বাঁচিনা। বলেই এবারে অহনা যেনো জমে গেল্। নিতু উৎসুক হয়ে রইলো । কারন নিতু এর তার  কাছ থেকে জেনেছিলো যে অহনার কারো সাথে রিলেশন আছে। কিন্তু এ ব্যাপারে সে কখনো কিছুই বলেনি নিতুকে। নিতুর একটা দারুন চাপা অভিমান ছিলো ।তার কেবলই মনে হতো ,ওদের এত এত বছরের বন্ধুত্ব তবু অহনা তাকে কিছুই বলেনা । এটা কি ঠিক? সে নিজেই জানে যে  এটা ঠিক না । অন্য কারো কাছ থেকে এ ব্যাপারে শুনতে তার ভালো লাগে না ।

 

অন্য কারো কাছ থেকে কোন কিছু জানতে চাওয়া এটা নিতুর স্বভাব বিরুদ্ধ। তবু আজ চেয়েছিলো যে অহনা হয়তো কিছু বলতে চাইছে। নিতুর অভিমান একদম ঠিক আছে । এক্ তরফা বন্ধুত্ব কখনো সঠিক দিশায় যায় না। নিতু একমাত্র বন্ধু বলে ভাবে অহনাকেই। তাই বিনা দ্বিধায় সব অবিরাম বলে দেয়। আজ এই প্রথম অহনা বোধহয় লজ্জা পেলো। খুব লাজুক কন্ঠে বললো,  

- নিতু আমি তোকে কিছু বলতে চাই। নিতু হালকা হাসি নিয়ে চেয়ে রইলো। কোন জবাব দিলো না। অহনা সবই বুঝতে পারলো।

- নিতু আমি জানি তুই আমার উপর রাগ করে আছিস। কিন্তু জানিস কতবার ভেবেছি , তোকে সব বলবো । নিজের হৃদয়ের কথা কাউকে বললেই শান্তি পাওয়া যায়। দেখ আমি জানি তুই ইতিমধ্যেই অন্য কারো মুখ থেকে কিছু জেনে থাকবি। তার কত টুকু সত্যি মিথ্যা আমি জানিনা ।

আদিত্য আমার খুব ছোট বেলার খেলার সাথি ছিলো। ও আমার এক ক্লাশ উপরে পড়তো। আমি পল্লীমোঙ্গোল গার্লস স্কুলে পড়তাম।ও পড়তো বয়েজ স্কুলে। ওরা আমাদের ভাড়াটে ছিলো।আমাদের একতলায় থাকতো।ওর বাবা ছোট খাটো একটা জব করতো। তিন ভাইবোনের মধ্যে আদিত্যই সবার বড় ছিল। খুব ভাল্ ছাত্র ছিলো । মেট্রিক , ইন্ট্রারমিডিয়েটে দুটোতেই স্ট্যান্ড করেছিলো। কিন্তু মাঝপথে পড়া বন্ধ হবার উপক্রম। ওর বাবার ওই ছোট্ট চাকরীটাও চলে গেলো । এদিকে আমাদের দুজনের ভালোবাসা তখন তুঙ্গে। একজন অন্যজনকে ছাড়া ভাবতেও পারিনা। মেডিকেল লাইনে পড়বে বলে আদিত্য প্রস্তুতি নিয়েছিল । নিজেই নিজেকে প্রস্তু্ত করেছিল । কিন্তু ওর বাবাতো হাত গুটিয়ে নিলো পুরোপুরি। একদিন আমার সামনে আদিত্য খুব কাঁদলো । আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম ,

- আদিত্য তুমি ডাক্তারি পড়বে। অসুবিধা নাই।

আদিত্য অবাক হয়ে বললো – তুমি কি পাগল হয়ে গেলে ? তুমি জানো মেডিকেলের পড়ার কত খরচা ?

- আমি দেবো সব খরচা , তুমি ভেবো না ।

- এটা অসম্ভব অহনা। আমি জানি তুমি অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে। কিন্তু তোমারতো নিজের কোন ইনকাম নাই।

- ওসব নিয়ে তুমি ভেবো না।

এরপর থেকেই আমি লুকিয়ে প্রাইভেট পড়াই দুটো বাচ্চাকে। ওই টিউশনির সমস্ত টাকাটা আমি আদিত্যকে পাঠিয়ে দেই। আজ তিন বছর ধরে এভাবেই চলছে। মাঝে মধ্যে মায়ের কাছে থেকেও কিছু টাকা মিথ্যা কথা বলে বলে চেয়ে ওকে পাঠাতে হয়। ওর ফর্ম ফিল আপের সময় এক্সট্রা টাকা লাগতো । যদিও ও আমাকে কিছু বলে না। এর মধ্যে হঠাৎ পেপারে দেখলাম টি এন টি বোর্ডে লোক নিয়োগ করবে । আমি এপ্লাই করেছি। ইন্টারভিউ দিয়েছি । চাকরীটা হয়ে যাবে মনে হয় ।

- ওহ তাইতো বলি তুমি হঠাৎ অনার্স ফাইনালে এসে এই চাকরীর জন্য এপ্লিকেশন করলে কেনো ?

- নারে টিউশনি করে আর হচ্ছিলো না।

- কিন্তু তোমাদের বাড়ীতে রাজী হবে ? তাছাড়া পড়াশুনা করে এই ফুলটাইম জব কি ভাবে করবে ?

- অসুবিধা নাই , আপাতত নাইট শিফটে করবো ।

- তোর নিজের পড়াশুনা ?

- আরে ওখানে তেমন কাজ কই ? ফোন আসবে , কমপ্লেন আসবে । এসব সমাধান করতে হবে । তার মধ্যে আমার পড়াশুনাটা ঠিকই সেরে ফেলবো ।

আদিত্যও পড়ার ফাঁকে একটা টিউশনি করে। আসলে ঢাকায় থাকা খাওয়ার খরচা অনেক বেশীতো ! এর মধ্যে আবার ছুটে ছুটে আসে আমার সাথে দেখা করার জন্য।

- তোরা কোথায় দেখা করিস , যখন আদিত্য আসে ?

- আদিত্যর এক কাজিন আছে , সে দোলখোলায় থাকে বউ বাচ্চা নিয়ে।ওখানে এসে ওঠে। আমি ওখানে গিয়ে দেখা করি । জানিস আদিত্য আমাদের বিয়ে নিয়েও কথা বলে যে আমাদের বিয়েটা জলদি সেরে ফেলা উচিত । - হু ! ভালইতো ; তোমাদের যা ব্যাপার শুনছি। তোমাদের ক্ষেত্রে বিয়েটা করেই ফেলা উচিত ।

- কেনো রে , তোর কি মনে হচ্ছে আমার সাথে ও বিশ্বাস ভঙ্গ করতে পারে ?

- তা না, বহু বছর ধরে একে অপরকে চেনো জানো , তাই জড়িয়ে পড়তে দোষ কোথায় ?

- আসলে ওতো ছাত্র , তাই ভাবছি ...

- আসলে জানোতো ,মানি প্লান্ট এর সব সময় একটা শক্ত খুঁটির দরকার হয় । এই কথায় অহনার মুখাবয়ব বেশ চিন্তা যুক্ত মনে হলো ।

এরপর অহনা টিএন টি তে চাকরি পেয়ে গেলো । চাকরি এবং পড়াশুনা এক সাথে চালিয়ে যেতে হচ্ছিলো । বেশ কষ্ট হচ্ছিলো । তবু তার আদিত্যর জন্য সে সব কিছুই করতে পারে। অনার্স পরীক্ষার সময় পরীক্ষা চলা কালিন সময়টা ছুটি নিয়েছিল। এত ঝামেলা করে পড়াশুনা করেছে ,তবু অনার্সে আপার ফার্স্ট হলো । এদিকে আদিত্যর ও মেডিকেলে চার বছর ভালো ভাবেই কেটে গেলো। ওর রেজাল্টও খুব ভাল হলো । এরপর ওকে ইন্টার্নি করতে পিজি হাসপাতালে পাঠালো । এখন আদিত্যর নাইট ডিউটি পড়লেই অহনা ফোন করে। পেসেন্টের ডাক পড়লেই কেটে দেয় ,আবার করে। এবারে একদিন অহনা নিজের থেকেই বললো –  তুমি অনেকদিন থেকে বলছো, এবারে বরং তোমার আব্বাকে আমাদের বাসায় পাঠাও বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে  - কিন্তু এখনোতো চাকরী পাইনি । দাঁড়াও চাকরীটা পেয়ে নাই।                                                                                                - কিন্তু তারতো এখনো অনেক দেরী। প্রায় তিন বছরের ধাক্কা । ইন্টার্নী করা অবস্থাতেও তো অনেকে বিয়ে করে।

 - আরে না অহনা তুমি বুঝছোনা ! এখন অবস্থাটা অন্যরকম।

- কি রকম ? এতদিন তো তুমিই বিয়ে বিয়ে করছিলে ! আর এখন আমি নিজে থেকেই বলছি , আর তুমি বাহানা করছো !

- আরে না সোনাপাখী ... এখন হয়েছে কি ,আমরাতো ধরতে গেলে এখনো স্টুডেন্ট। এখন বরং আগের থেকেও খারাপ পজিশন। যখন তখন ডাক দেয় ।

- আমি এসব জানি আদিত্য । এতদিন তুমিইতো বিয়ের ব্যাপারে বলছিলে।

- সেতো ঠিকই। তবে এখন পরিস্থিতি একদমই আলাদা ,বুঝলে ?

- আমারো পরিস্থিতি একদম চেঞ্জ হয়েছে বুঝলে ? এমনিতেই টিএনটির এই চাকরী নেবার পর থেকেই বাড়ীর থেকে খুবই অশান্তি করছে ।

- তাহলে এক কাজ করো চাকরীটাই ছেড়ে দাও।

- কেন চাকরী ছাড়বো কেনো ? তোমার আর টাকার দরকার নাই ?

- না ওরা এখন আমাকে যা দিচ্ছে তাতে আমার চলে যাচ্ছে ,তাছাড়া পিজির উপরে এক রুমের একটা বাসস্থান ও পেয়েছি।ব্যাচেলরদের জন্য করা আছে।

- তাহলেতো তোমার সমস্যার সমাধান।

- হ্যা তা বলতে পারো। এখন তুমি মন লাগিয়ে পড়তে পারো।

- আদিত্য , এখন আমার প্রবলেম শুরু হয়েছে। এখন বাসা থেকে খুব বিয়ের জন্য প্রেসার দিচ্ছে। এখন তো তোমার কিছু বলা উচিত।..

- দেখো অহনা , তুমিতো আমার স্বপ্নের কথা সবই জানো ! আমি মাঝপথে সব ডুবাতে চাইনা। দেখো তুমি আমাকে আজ এই পর্যন্ত আনলে ! এখন আর অন্তত দুইটা বছর দাও প্লিজ ! অহনার মনটা খুবই খারাপ হলো । আদিত্য বরাবরি এইরকম। নিজের কথাই সে খুব বেশী ভাবে। অনেকটা সময় সে বিমর্ষ হয়ে রইলো। তবু বিষন্ন কন্ঠে বললো –

ঠিক আছে আদিত্য , তুমি যে সময় চাইলে আমি তোমাকে সেটাও দিলাম। যদিও এটা আমার জন্য খুবই কঠিন হবে।

- অনেক অনেক ধন্যবাদ সুইটি। অহনা কোন জবাব দিল না ।

এরপর মেঘে মেঘে অনেক বেলা চলে গেছে। অহনা এম এ পাশ করেছে।ওর আরো দুটো প্রমোশন হয়েছে তার কর্মস্থলে। এই সময়টাতে আদিত্য খুবই কম যোগাযোগ করেছে। অহনাও তাকে কোন ডিস্টার্ব করে নি। কারন সে আদিত্যকে শুধু পাগলের মতো ভালোই বাসে না, অন্ধের মত বিশ্বাসও করে। যদিও ওদের কমন বেশ কিছু বন্ধু , যারা ওদের সম্পর্কের কথা জানে প্রথম থেকে ; তাদের মধ্যে সুদীপ নামে একটা বন্ধু আছে। সে হঠাৎ করে মাস ছয়েক আগে ওর অফিসে এসে একদিন দেখা করলো । অহনা খুব অবাক হলো । বললো –

তুই যে ,খুলনায় কবে এলি ?

- এইতো গত পরশু এসেছি।

- আচ্ছা একটু ওয়েট কর , আমি আসছিরে। অহনা অফিস থেকে একেবারে ছুটি নিয়ে বের হয়ে গেলো। সুদিপও ঢাবি থেকে এপ্লাইড ফিজিক্সে পাশ করে একটা কলেজে জব পেয়েছে। ওদের পাড়াতেই সুদিপ্ রা থাকে। ওরা হাটতে হাটতে অনেক প্রগলভ হয়ে গেলো । ছেলে বেলার অনেক কথা বলতে বলতে দুজনে রীতিমত হাহা হিহি করতে লাগলো। একসময় ওরা হোটেল ডিলাক্সের কাছে চলে এলো ।

- কিরে ডিলাক্সে এলি যে বড় ?

- আয় একেবারে লাঞ্চটা সেরে নেই। আমি লাঞ্চ করিনি।

-ওকে চল , আজ আমি তোকে খাওয়াবো ?

- উহু ! আমি যখন ঢাকায় যাবো তখন তুই খাওয়াবি। অহনা ডিলাক্সে ঢুকার সাথে সাথে আলী নামে একজন বেয়ারা ছুটে এলো –

- আপা কি আনুম?

- ফুল প্লেট একটা আর হাফ প্লেট একটা চিকেন বিরানী আনো । আর খাশীর দুইটা চাপ আনো । আর খাবার পর দুইটা ফালুদা আনবে।

- ওরে বাপস !! তুই দেখি একেবারে বিয়ে বাড়ীর খানা অর্ডার করলি! অহনা মিস্টি করে হেসে বললো।

- তারপর বল কেমোন চলছে সব ?

- এইতো মা বাবা একটা মেয়ে ঠিক করেছে আমার জন্য। আগামী পরশু আশীর্বাদ। তোকে নেমতন্ন করতে এলাম ।

- ওমা বলিস কি?

- হ্যা মেয়ে ভালই, এবারে বি এল কলেজ থেকে বায়োলজিতে মাষ্টার্স করেছে ।

- খুব ভালো হয়েছেরে।

- তা তোদের খবর কি? তোর না বিসিএস দেবার কথা ছিলো ?

- হ্যা এবারে দিয়েছি রিটেন, দেখি কি হয়?

- কি চয়েস দিলি ?

- মাষ্টারীই এক নম্বর চয়েস ছিল। আর খবর জানি না। আর অন্য খবর বলতে, আদিত্য কবে যে বিয়ের জন্য হ্যা বলবে বুঝছি না।

- যদি নির্ভয় দিসতো একটা কথা বলি?

- আরে কি আশ্চর্য! আমার সাথে কথা বলার জন্য তোর পারমিশন লাগবে নাকি?

- না আফটার অল তোরা দুজনই আমার বন্ধুতো! সমস্যাটা ওখানেই । আসলে অনেকদিন থেকেই শুনছি আদিত্যর একটা মেয়ের সাথে এফেয়ার আছে। তো আমি ব্যাপারটা সিওর হবার জন্য অনেকবার ওকে ফোন করেছি।ফোন কেটে দেয় । এমন কি একদিন পিজিতেও গেলাম, সেখানেও জরুরী কাজ বলে এড়িয়ে গেলো। শুনেছি, ঢাকা মেডিকেলে পড়বার সময় থাকতেই এক নার্সের সাথে প্রেম চলছিলো। ওখানে আমার এক কাজিন আছে, তাকেও আদিত্যর ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করাতে, সেও একই কথা বলল। তবু তোকে এতদিন কিচ্ছু বলিনি। তবে গত মাসে হঠাৎ গাউসিয়াতে গিয়েছিলাম কিছু জিনিষ কিনতে।ওখানে দুর থেকে হঠাৎ করে আদিত্যকে দেখলাম, একটা মেয়ের সাথে। আমি দূর থেকে অনেক্ষন অবজার্ভ করে অনেকটা পালিয়ে এসেছি। এখন তোকে না বলাটা, একেবারে বেঈমানির পর্যায়ে পড়ে যাবে বলে বলছিরে। অহনা চুপচাপ শুনে গেল। কোন জবাব দিলো না। বরং আগের মতই হাসি মুখে খেয়ে গেলো । তবে ভ্রুটাতে কিঞ্চিত চিন্তার ভাঁজ পড়লো। পরদিন অফিসে যেয়ে নীতুকে সব বললো। সেতো উল্টা চিল্লাপাল্লা শুরু করলো -এখুনি ফোন দে।তোর এই বিশ্বাসই একদিন কাল হবে ।

- ওকে বাবা দিচ্ছি। এরপর অহনা ক্রমাগত ফোন দিয়ে গেল।ঢাকাতে, আদিত্যর দেওয়া সব কটা নাম্বারেই ট্রাই করে গেল। কোন রেসপন্স নাই। অতঃপর আদিত্যর ঠিকানায় একটা চিঠি দিলো। তাও তিন মাসের মত হয়ে গেলো। তখন নিতুই বলল - এটা জীবন মরন সমস্যা। তুমি এক কাজ করো , তিন্ দিনের ছুটি নিয়ে ঢাকায় গিয়ে একেবারে সরেজমিনে তদন্ত করে আসো। সেই মোতাবেক অহনা ঢাকা যাবার 

প্লেনের টিকিটও বুক করে ফেললো । আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহেই যাবে। আদিত্যকে জানালো না।ওকে সারপ্রাইস দেবে বলে ঠিক করলো ।

- কিরে বাড়ি যাবি বলেও উঠছিস না যে , কি হলোরে তোর ? এই অহনা ?

- নিতু অতঃপর অহনার হাত ধরে জোরে একটা ঝাকুনি দিল । এতক্ষনে অহনা তার হাতের চিঠিটা নিতুর দিকে বাড়িয়ে ধরলো। নিতু অনেকটা ঝাপিয়ে পড়লো চিঠিটার উপর –

অহনা,

আমি জানি গত তিন/ চার মাসে তুমি আমাকে অসংখ্যবার ফোন দিয়েছো।আমি ফোন ধরিনি । এমনকি তোমার চিঠিরও জবাব দেইনি। কি জবাব দিবো বল? তোমাকে বলার মত আমার যে কিছুই নাই ! আমি অত্যন্ত অপারগ অহনা। আসলে ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা একদম আলাদা ব্যাপার। ঢাকা মেডিকেলে যখন তৃতীয় বর্ষে পড়ি, তখনই প্রথম দেখি আলিনাকে। ওই দেখাটাই কাল হলো । বুঝলাম ওই দেখাই আমার জীবনের সর্বনাশ হলো। ওকে দেখার পরই বুঝলাম প্রকৃত প্রেম কি জিনিষ? আমি ওকে ছাড়া বাঁচতেই পারবোনা। আমি জানি তুমি আমার জন্য যা কিছু করেছো, সেটা আমার নিজের বাবা মাও করতে পারবে না । কিন্তু অহনা কৃতজ্ঞতার বোঝা নিয়ে, ভালোবাসার ঘর করা যায় না।আমি আসলে গত বছরেই আলিনাকে বিয়ে করে ফেলেছি। প্লিজ পারলে তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। আর আমি চাকরী পেলে তোমার পাঠানো প্রতিটি পয়সা, হিসাব করে শোধ করে দিবো। আর তুমি তোমার বাবা মায়ের পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করে ফেলো। ভালো থেকো ।

 --আদিত্য।

 অনেক্ষন হলো সূর্যটা ডুবে গেছে। তার লালিম আভা চারদিক ছড়িয়ে পড়েছে। শরতের মৃদু মন্দ হাওয়ায় দুলছে কাশবন। ভালোবাসা কখনো শেষ হয়ে যায় না। নিতু গভীর মমতায় অহনার হাত দুটো জড়িয়ে নিলো ওর করতল দিয়ে। রাস্তায় নেমে এলো দুটো বিষন্ন ছায়া ।