নারকেল গাছ

Writer: Shabbeedur Shuja Category: ছোট গল্প (Short Story) Edition: Dhaboman - Fall 2018

 

ঢাকার আকাশে ভাসছে প্লেনটা, ঘন সাদা মেঘের ফাঁক দিয়ে নীচে, বহু নীচে, হঠাৎ হঠাৎ নজরে আসে ঘন সবুজের ছোপ আর লম্বা রশির মত বিছিয়ে থাকা রুপালী নদীর ঝলক। অধীর অপেক্ষায় জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে লতা, তার হৃদয়ে আবেগের ঘনঘটা, গলায় বুদ বুদ করে উঠে আসা এক অদ্ভুত অনুভুতির খেলা। প্রতিবার যখনই সে দেশে বেড়াতে আসে তার একই অনুভূতি হয়। নিজের দেশ, নিজের মাটির সাথে কি কোন কিছুর তুলনা হয়? বিশেষ করে পরিবারের সবাইকে ছেড়ে দূর কোন দেশে গিয়ে কি থাকা যায়? তার পাশে তার বারো বছরের মেয়ে গভীর মনযোগ দিয়ে এন্টারটেইনমেন্ট সিস্টেমে একটা মুভি দেখছে। স্বামী আসে নি। কাজে ছুটি পায় নি। পেলেও আসতে চায় না। বাংলাদেশের এতো হৈ হট্টগোল তার ভালো লাগে না। লতার আবার সেটাই ভালো লাগে। ঢাকা শহরে বড় হয়েছে, ভীড় ভাট্টা নিয়েই জীবন কেটেছে। অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। সেই অভ্যাস এতো বছরেও যায়নি।

ঢাকার আকাশে আসতে নজর একেবারে আঁঠার মত সেটে গেল লতার। প্লেন ল্যান্ডিঙ্ করবে। ধীরে ধীরে নীচে নামছে। মেঘের নীচের ব্যস্ত শহরটা হঠাৎ যেন মেঘ ফুড়ে এক যাদুপুরির মত তার চোখের সামনে নিজের সব রূপ মেলে ধরেছে। সবুজ আর ধুসরের সমুদ্রে কিলবিল করছে কংক্রিটের অসংখ্য দালানকোঠা। পরিচিত শহর, পরিচিত মানুষেরা, কত ভালোলাগা আর ভালোবাসার স্মৃতিতে ঘেরা। সে যেন তাদের মীরপুরের বাসার চারদিকের মাটির সোঁদা গন্ধ পায়, বিশাল আমগাছের ডালে ডালে ঝুলে থাকা শত শত সবুজ আমের মন মাতানো ঘাণ তার হৃদয়ে আকুলি বিকুলি কাটে, তার আর তর সয় না। সে মেয়েকে ডাকে, “মা, দ্যাখ, ঢাকা!”

মেয়ে দ্রুত একবার বাইরে চোখ বুলিয়ে মুখ বাঁকা করে বলল, “কি নোংরা!”

হাসে লতা। তার নিজেরই সূচি বায়ু আছে। সারাক্ষণ সব কিছুতে ময়লা দেখে। মেয়ে যে সেটা পেয়েছে তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই কারণ তার বাবার নাকের ডগায় আবর্জনা ফেললেও সে টের পাবে না। কিন্তু এই শহরে লতা নোংরা দেখে না। যেখানে তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিনগুলো পড়ে আছে, স্মৃতির পাতায় পাতায় গুনগুনিয়ে গেয়ে চলেছে ছেলেবেলার মধুময় সব অধ্যায়, সেখানে কি কখন কোন অসৌন্দর্যের ছাপ পড়তে পারে?

প্লেনটা ল্যান্ডিং করে বসে আছে। সিঁড়ি আসার জন্য অপেক্ষা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে এয়ারপোর্টের ব্যস্ততা দেখছে লতা। সে-ই প্রথম উড়াল দিয়ে দূর দেশে যাবার স্মৃতি মনে পড়ে যায়। মনে হয় যেন সেদিনের কথা অথচ বিশ বছর পেরিয়ে গেছে। চোখের পলকে।

বাবা তাকে বিদেশে বিয়ে দেবেন না বলে বদ্ধপরিকর ছিলেন। অনেকগুলো প্রস্তাব উৎসেই বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ছোট মেয়েকে ছাড়া তিনি থাকতে পারবেন না। তাছাড়া সে সব দূর দেশে ছেলেগুলো কি করে না করে সঠিকভাবে জানা যাবে কিভাবে? শেষে আদরের মেয়েটা কোন দূর্বিপাকে পড়বে। কিন্তু ভবিতব্য একেই বলে। এক ছেলের বাবাকে দেখে তার বাবার মত পালটে গেল। এমন নুরানী চেহারার ভদ্রলোকের সন্তানেরা কি খারাপ হতে পারে? দুই সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে, তৃতীয় সপ্তাহে স্বামীর সাথে আমেরিকা। বাবাকে ভালো করে বিদায় জানাবার সুযোগ হল না লতার। ঘোরের মধ্যে কেটে গেল শেষ কয়েকটা দিন।

     প্লেনের সিঁড়ী চলে এসেছে। মেয়েকে নিয়ে নেমে এলো লতা। ডিপার্চারে গেল। তার বড় ভাইয়ের গাড়ী নিয়ে আসার কথা তাকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে যাবার জন্য। চেক আউট করে বাইরে এসে দেখল তার বড় ভাই এবং সেঝ ভাই গাল ভর্তি হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুই ভাইকে নিঃশব্দে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকল সে। আঠারো বছর আগে দেশে ফিরে এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে বড় ভাইকে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল সে। বাবার সাথে তার আর দেখা হয় নি। হার্ট এটাকে হঠাৎ দূর কোন অজানায় হারিয়ে গিয়েছিল তার সবচেয়ে প্রিয় মানূষটা।

      মীরপুরের বাসায় বড় বোন থাকে। মা সেখানে বেড়াত গেছেন। বড় এবং সেঝ দুই ভাই অন্য জায়গায় ঘর বেঁধেছে। বড় বোনের সাথে থাকে ছোট ভাইটা। অকর্মা। চল্লিশ বছরের ব্যাচেলর। গাজা ভাঙও নাকি চলে। শুনলেই শরীরটা জ্বলে ওঠে লতার। তাদের মত এমন একটা ভদ্র পরিবারে এই অপগন্ডটা কোথা থেকে সে জুটেছিল?

    বড় ভাইয়ের গাড়ীতে জিনিষপত্র তোলা হয়। মীরপুরে মায়ের সাথে দেখা করতে চায় লতা। আপাতত সেখানেই উঠবে। রাস্তায় ভীড়। ঢিমে তালে চলছে গাড়ী। চারদিকে পরিচিত শহর। ধুলি ধূসরিত, জনে জনারণ্য, তবুও এখানে এলেই কেন যেন লতার সমস্ত অস্তিত্বে এক শিহরণ ওঠে, কত স্মৃতি বিজড়িত এই শহর, কত ছোট খাট ঘটনা আর হাসি কান্নায় মেশান চত্বর। মেঝ ভাইয়ের কথা মনে পড়ে যায়। বছর তিনেকের বড় ছিল। একেবারে যমজ মনে হত ওদের দুজনকে। সুঠাম, সুদর্শণ ছিল, ছোট বোন অন্ত প্রাণ ছিল। সেই ছোট বেলা থেকেই আগলে রেখেছিল লতাকে; কেউ কিছু বললে তেড়ে যেত, কোন কিছু চাইলে দৌড় দিয়ে এনে দিত; বড় হবার পর কলেজে নিয়ে যেত, নিয়ে আসত, যত রাতই হোক; বিয়ের সময় একাই একশ মানুষের কাজ করেছিল। বিয়ের পর প্রথমবার যখন কানাডা থেকে ফিরেছিল ভীষণ খুশী হয়েছিল। অনেক হৈ চৈ করেছিল। তার নিজেরও বয়েস হচ্ছিল। সফলতা আসছিল না। কিন্তু লেগে ছিল। অনেক স্বপ্ন দেখত। একদিন সফল ব্যবসায়ী হবে। লতা ভাইয়ের বিয়ের কনে দেখবার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিল। মেঝ ভাইয়ের বিয়ে সে খুব জাক যমক করে দেবে। তার অনেকদিনের স্বপ্ন ছিল।

    এক সন্ধ্যায়, কানাডাতে, বাসায় একটা ফোন এলো। তার স্বামীর সেলফোনে। দুই দিন পর রাতে ভয়ে ভয়ে খবরটা দিল সে। হঠাৎ হার্ট এটাক। হৃতপিন্ডে আগেই সমস্যা ছিল। অসময়ে চলে গেল তার সবচেয়ে বড় বন্ধু।

     লতা কত রাতে স্বপ্ন দেখে জেগে গেছে – কখন দেখেছে বাবাকে, কখন মেঝ ভাইকে, কখন দু জনাকেই। তারা তাকে দেখে হাসে, কথা 

বলে।

     মীরপুরের বাসায় পৌঁছেই ব্যাপারটা নজরে পড়ল লতার। বড় বোন, দুলাভাই এবং ভাইগ্না-ভাগ্নীর সাথে আলাপের ফাঁকে বাড়ীটার পূর্ব প্রান্তে তার দৃষ্টি থমকে যায়। গতবার যখন এসেছিল, তখনও নারকেল গাছটা মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়েছিল সেখানে। এখন শুধু সমতল। তার প্রশ্নবোধক দৃষ্টি দেখেই বড় বোন বলল, “গাছটার গোড়ায় পচন ধরেছিল। বেশ কয়েক বছর কোন ফলন হচ্ছিল না। বাতাসে পড়ে গিয়ে সমস্যা করবে তাই কেটে ফেলে দিয়েছি।”

       লতার দু’ চোখ জলে ভিজে গেছে। সে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ল। কিছু বলল না। বাবা আর মেঝ ভাই মিলে গাছটা লাগিয়েছিল। সে তখন বোধহয় দশ-বারো। সেদিন টিপ টিপ করে বৃষ্টি হচ্ছিল। তার মধ্যেই দু’ জন ভয়ানক আগ্রহ নিয়ে মাটি কুপিয়ে, সার মিশিয়ে গাছটা পুতে চারদিকে উঁচু করে কাঠের গুড়া দিয়েছিল। পরের কয়েকটা সপ্তাহ লতা আর মেঝ ভাই দু’ জনে মিলে খুব পরিচর্যা করল গাছটার। ধীরে ধীরে সেটা হয়ে উঠেছিল তাদের জীবনের এক অপরিহার্‍্য অঙ্গ, স্থবির কিন্তু অন্তরঙ্গ, নীরব কিন্তু কি ভয়ানক জীবন্ত! বাবা তাদের কান্ড দেখে হাসি মুখে বলত, “তোরা দুইটা খুব পাগল! হাঃ হাঃ।” তার সেই ছেলেমানুষি হাসির শব্দ আজও কানে ভাসে।

    বড় বোন তাকে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেল। লতার মেয়ে মায়ের হাত ধরে ফিসফিসিয়ে বলল,”মা, তুমি ঠিক আছো?”

লতা নিঃশব্দে মাথা দোলাল। তার কন্ঠ ভারী হয়ে এসেছে। কথা বলার অবস্থা তার নয়।

 

    শেষ রাতে ঘুম ভেঙে গেল লতার। খুব অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখেছে। সে কোথায় যেন হাঁটছে। হঠাৎ একটা আট-নয় বছরের ছেলে তার কাছে এসে বড় বড় চোখ মেলে বলল, “এই লতা, কি করিস এখানে? বাসায় যা। গাছে খুব সুন্দর ডাব হয়েছে। পানি যা মিষ্টি না!”

ঘুম ভাঙার পর মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে কাঁদল লতা। ফযরের সময় হয়ে যাচ্ছে। উঠল। অকর্মাটা কোণার একটা ঘরে থাকে। ছোট থাকতে ছোট আপু বলতে অজ্ঞান ছিল। সারাক্ষণ এটা সেটা এনে খুশী করার চেষ্টা করত। একটু বড় হতে কেমন যেন সব গোলমাল হয়ে গেল ওর। কোন কিছুতেই কিছু হল না। লতার বিয়ের পর শুনেছে নেশা টেশা ধরেছে, পূনর্বাসনের চেষ্টা করা হয়েছে, খুব একটা ফল হয় নি। ভালো হয়ে ফিরে এসে আবার ধরেছে। বিমুখ হয়ে ধীরে ধীরে তার পাশ থেকে সরে গেছে সবাই। লতার কতবার মনে হয়েছে ওর সব সোনা দানা বেঁচে এই পাগলটার কিছু একটা ব্যবস্থা করে। সবাই ওকে নিষেধ করেছে। সবার বিশ্বাস হারিয়েছে ওদের বাসার সেই ছোট্ট আদুরে ছেলেটা।

দরজায় দুইটা টোকা দিতেই লাফিয়ে এসে দরজা খুলল অকর্মাটা। “ছোট আপু! জানতাম তুমি আসবা। সারাদিন আমার সাথে একটু ভালো করে কথাও বল নাই।”

“তুই ঘুমাস না?” লতা অবাক হয়ে জানতে চায়।

“ঘুম আসে না। মনে শান্তি নাই তো। দেখ না, একা একা। কেউ ভালোবাসে না আমাকে। মা, ভাই, বোন – কেউ না।” কিছুক্ষণ অহেতুক খ্যাক খ্যাক করে হাসে সে।

লতা ভ্রু কুঁচকে বলল, “আস্তে হাস। সবাই ঘুমাচ্ছে। তুই গাজা ভাং খাস?”

“কে বলছে? এইসব বাজে কথা বিশ্বাস কর কেন?”

লতা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল। ওকে দেখলেই বোঝা যায় নেশায় বুদ হয়ে থাকে। এখনও মনে হচ্ছে স্বাভাবিক নয়।

“কিছু লাগবে ছোট আপু? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে কিচ্ছু একটা বলতে আসছ।”

“এদিকে নারকেল গাছ পাওয়া যায় রে? ছোট গাছ?”

“আরেকটা গাছ লাগাবা? পাওয়া যাবে। চিন্তা করো না। আমি ঠিকই জোগাড় করব। মেঝ ভাইয়ের জন্য আমারও খুব মন খারাপ হয়। একমাত্র সেই আমাকে একটু দেখত। বাবার জন্য তত খারাপ লাগে না। আমাকে খামাখা বকা দিত।”

লতা বিরক্ত কন্ঠে বলল, “পারলে একটা গাছ আনিস।”

ফিরে যাচ্ছিল। পেছন থেকে অকর্মাটা বলল, “এই গাছটা তুমি আর আমি একসাথে লাগাব, ঠিক আছে ছোট আপু?”

মাথা দোলাল লতা, কিছু বলল না। এই পাগলের সাথে বেশীক্ষণ কথা চালানোও ভয়ের ব্যাপার। কি বলতে কি বলে। নেশাখোরদের কোন ঠিক ঠিকানা আছে?

 

দু’ দিন বাদে সত্যি সত্যিই একটা বেশ বড় সড় নারকেল গাছের চারা নিয়ে হাজির হল অকর্মাটা। নিজেই কোদাল জোগাড় করে মাটি কোপাল। সার মিশিয়ে মাটিটাকে ঠিক ঠাক করল। শেষে লতা আর সে দু’ জনে মিলে গাছটাকে সযত্নে মাটিতে পুতল। লতা মেয়েকে ডাকল, সে গেল না। মাটি-ফাটিতে সে হাত লাগাতে চায় না।

মাটিতে পোতার পর গাছটা দেখে বেশ মন জুড়িয়ে গেল লতার। দেখে মনে হচ্ছে এক সপ্রতিভ বালক তার সবুজ পেখম মেলে আকাশের দিকে ধাবিত হবার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে।

“ছোট আপু, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

“কর।“

“যদি কানাডা চলে গিয়ে একদিন শোন আমি আর নেই, আমার জন্য একটু কাঁদবে তুমি?”

লতা তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল, “বাজে কথা বলছিস কেন? এইসব ফালতু কথা আমার কাছে বলবি না।”

খিল খিল করে ছেলেমানুষের মত হাসল ছেলেটা। “আমি জানি তুমি অনেক কাঁদবা। তারপর তুমি যখন দেশে আসবা, এই গাছটা দেখলে আমার কথা মনে পড়বে। পড়বে না?”

লতা ফিসফিসিয়ে বলল, “এইসব কথা কেন বলছিস?”

হঠাৎ বোনকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে ছেলেটা। “আবার যদি ছোট হয়ে যেতে পারতাম, ছোট আপু!”