দ্য স্লীপ অব এনডাইমিয়োন

লেখক: সৈয়দ মাহমুদ Category: ছোট গল্প (Short Story) Edition: Dhaboman - Fall 2018

আমার চিরদিনের বোহেমিয়ান জীবন এখন ভিন্ন এক জগতে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। এই আচ্ছন্নতা আমার নিজের কাছেই আমাকে অপরিচিত করে তোলে। এই আমি কি সেই আমি? নিজেকে প্রশ্ন করি মাঝে মাঝে। কিন্তু সদুত্তর মেলেনা। মাধবী’র আকস্মিক হারিয়ে যাওয়া আমার কাছে যেমন একটি বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে আছে তেমনি তার জন্য প্রতীক্ষা আমার জীবনাচরণ পাল্টে দিয়েছে অনেকাংশে। প্রতিদিন অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা চলে যাই শাহবাগে। হাঁটতে থাকি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর, টিএসসি তারপর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে বসে থাকা। এই এলাকায় মাধবীকে দেখার স্মৃতি আমাকে তাড়া করে। মনে পড়ে যায় সে আমাকে প্রথম পরিচয়ে স্পর্শ করেছিল। পুলিশের রাইফেলের আঘাতের ক্ষতস্থান নিজের ওড়নায় বেঁধে একরকম টেনেই রিক্সায় তুলে একা আমাকে নিয়ে যাচ্ছিলো হাসপাতালে সম্পূর্ণ এক অপরিচিত তরুণী।

এই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে হাজারো শহীদের স্মৃতি ফলক আর মাধবীর স্মৃতি আমাকে ভাবনার গভীরে নিয়ে যায়। উদ্যানের ভিতর আমার পদচারণা প্রতিনিয়তই আমাকে আরও বেশী আবেগঘন ভাবনার অতলান্তে নিক্ষেপ করে। হাঁটতে ইচ্ছে করলে উঠে পড়ি, রাতের বেলা ফুলার রোডটা কিছুটা নির্জন থাকে বলে এ রাস্তায় হাঁটতে ভাল লাগে। হাঁটতে হাঁটতে শহীদ মিনার পার হয়ে দোয়েল চত্বর ঘুরে আবার উদ্যানে আসি অথবা শাহবাগ হযে ঘরে ফিরি। এই নিত্য অভ্যাস আমাকে ক্লান্ত করেনা কখনো। অথচ জীবনানন্দ তার কবিতায় সংশয় পোষণ করেছিলেন,“বেঁচে থেকে হয়ত হৃদয় ক্লান্ত হবে।” আমার হৃদয় কখনোই ক্লান্ত হবেনা মাধবী। এই যে এখানে বাতাসে তোমার স্পর্শ, তা আমার প্রাণশক্তি অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়। আমি বীরের মতো একাকী হেঁটে চলি অনন্ত জীবনের পথে।

অসম্ভব দেশপ্রেমে আপ্লুত মাধবী প্রবাসী বাবা-মা কে ছেড়ে এ দেশেই লেখা-পড়া শেষ করার এবং থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। মাধবীর প্রতি আমার মুগ্ধতার মূল বিষয়টা ছিল এখানেই। অসুস্থ্ বাবার জন্য তার মন খারাপের বিষয়টি মাঝে মাঝে আমার কাছে প্রকাশিত হয়ে যেত, কিন্তু মনোবল নষ্ট হতে দেখিনি কখোনো।তবে কি তাকে হঠাৎ করে কোন কারণে যেতে হলো, আমাকে জানানোর সময়টুকু পর্য্যন্ত ছিল না?

ছুটির দিন গুলোতে আমি চলে যাই ফুলবাড়িয়া, সেখানে এক বস্তিতে একটা স্কুলে মাধবী বাচ্চাদের পড়াতো। আমি সে ঠিকানা জানতাম না। ও চলে যাবার পর অনেক খুঁজে সেই ঠিকানা বের করেছি। বিভিন্ন বস্তি ঘুরে ঘুরে অবশেষে সেখানে পৌঁছলাম। কিন্তু মাধবীর কোন সন্ধান পেলাম না। তবে ওর সাথে আরও যে দুজন এই কাজে অংশ নিয়েছিল তাদের দেখা পেলাম। ওরাও জানতো না মাধবীর ঠিকানা, শুধু জানতো জিগাতলায় এক আত্মীয়ের বাসায় থাকে। সেই বাসা থেকে কোন এক ছোট ভাই একদিন হঠাৎ এসে বিদেশ থেকে জরুরী খবর আছে বলে তখুনি তাকে নিয়ে চলে গেল, এর পর আর কোন দিন সে আসেনি। আমি মাঝে মাঝে সেখানে চলে যাই, যদি মাধবীর কোন খবর পাই- সেই আশায়। বিগত দশ বছর আমি এই কাজ করে যাচ্ছি, কিন্তু মাধবীর সন্ধান মিলছেনা।  আমার যে অনেক কথা ওকে না বলা থেকে গেছে আবার অনেক কথা শোনাও হয়নি। কিন্তু একটা বিষয় তো দুজনার কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল-আমরা একে অপরের জন্য অনিবার্য। এটিতো শাব্দিক উচ্চারণে বলবার প্রয়োজন কখনো হয়নি এবং এটাও নিশ্চিত যে এ নিয়ে সংশয় কারোরই মনে কখনো আসেনি বা আসবে না।

আজ আমার কি হলো, কেন এত অস্থিরতায় ভুগছি মাধবী? দুঃসহ স্মৃতির ভিতর তোমার অস্তিত্ব-তোমার স্মৃতি সামনে আনতে চাইছি বার বার এতটুকু স্বস্তির আশায়। আমার এই চঞ্চল বিক্ষিপ্ত মনকে আমি শাসাচ্ছি, বলছি - স্থির হও, শান্ত হও, স্নিগ্ধ হও, হৃদয় খুঁড়ে জমাট বাঁধা যাতনার সাগর থেকে দু’ফোঁটা শুভ্র শিশির বিন্দু তুলে আনো-পুলকিত হও। সেটাইতো লড়ে যাওয়া একজন মানুষের জীবন। মনে মনে কথা গুলো ভেবে আমার চঞ্চলতা আনেকটাই কমে আসে। এখন আমার হাঁটতে ইচ্ছে করছে। হাঁটতে থাকি ধীরে ধীরে, গন্তব্য ফুলার রোড-যেখানে আমরা কতোনা দিন পাশাপাশি হেঁটেছি। আকাশে মেঘেরা এলোমেলো ওড়াউড়ি করছে। মেঘে মেঘে ঘর্ষণ হয়। আমি পুলকিত হই, বৃষ্টি নামুক, আজ আমি ভিজবো, স্থির-শান্ত হবো, স্নিগ্ধ হবো। রিমঝিম বৃষ্টি নামে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ফুলার রোড ধরে শহীদ মিনারের দিকে হাঁটতে থাকি-যেন পৃথিবীর সবথেকে স্নিগ্ধ যুবক সকল পঙ্কিলতা ধুয়ে অবিরাম হেঁটে চলে।

 

(দুই)

কবিতা পড়ে আর গান শুনে আমার রাত কেটে যায়। কোন কোন রাতে আমার ভীষণ মন খারাপ থাকে। তখন আমি মাধবীর ডায়েরি বের করে পড়তে থাকি। এ ডায়েরি মাধবীর দিনলিপি নয়। ওর কাছে একদিন জানতে চেয়ে ছিলাম,“রাতে ঘুম না এলে কি করো?” বলেছিল,“আমার তখন লিখতে ইচ্ছে করে, কখনো কবিতা লিখতে চেষ্টা করি, কখনো যা মনে আসে তা-ই লিখি।” আমি বলেছিলাম তোমার লেখা পড়তে ইচ্ছে করছে। ও বলেছিল,“ঠিক আছে, বছর শেষে নূতন ডায়েরি শুরু করবো যখন-পুরেনোটা তোমাকে দেব।” মাধবী তার কথা রেখেছিল, তিনটে ডায়েরি এখন আমার কাছে। ওগুলো আমার প্রাণ, মাধবীর স্মৃতি, মাধবীর স্পর্শ। পড়তে পড়তে রাত গভীর হয়, ভোর হয়ে যায় তবুও আমার ক্লান্তি আসেনা। কোন কোন লেখায় এসে আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে যাই, বার বার পড়ি- কেঁদে বুক ভাসাই। আহত আমাকে যেদিন সে হাসপাতালে নিয়ে গেল ঐদিন লিখেছে,“ সৃষ্টিকর্তা আমাকে এত শক্তি কোথা থেকে দিলেন, আমি সামরিক জান্তার লেলিয়ে দেওয়া একদল নরপিশাচের হাত থেকে একজন টগবগে তরুনকে একা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে এলাম। আমি যদি আজ ব্যর্থ হতাম আর যদি তোমার কিছু হয়ে যেত তবে কখনোই নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না। তোমার ক্ষতস্থানের সেই তাজা রক্ত আমাকে নূতন করে জীবনের অর্থ খুঁজে পেতে শেখালো।”

তার ক’দিন পর এক জায়গায় লিখেছে,“বিশাল বটবৃক্ষের মতো তোমাকে পেয়ে আমি তার ছায়াতলে মনে মনে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করলাম। নিজেকে ভীষণ সুখী আর নির্ভার মনে হলো।” আমার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে, জল গড়িয়ে বালিশ ভিজে যায়। ডায়েরিটা বুকে নিয়ে হয়ত ঘুমিযে পড়ি কিংবা জেগে থাকি সারা রাত।

কোন এক বর্ষায় মাধবী লিখেছেঃ

এখন গভীর রাত-ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে

যদি প্রশ্রয় দাও

তবে কোনো একদিন

এমন বৃষ্টিতে

তোমাকে জড়িয়ে ধরে রাজপথে হাঁটবো…..

বিকেলে অফিসে বসে মাধবীর সেই লেখাটা মনে পড়লো, কখনো কি ওর 

এই সামান্য চাওয়াটা পূর্ণ হবে না? মনে হলো টেলিফোনটা বেজে যাচ্ছে, বোধ করি তৃতীয় বার রিং হলো। তড়িৎ রিসিভার তুলতেই অন্য প্রান্তের কণ্ঠ,“আমি মাধবী বলছি।” আমি স্তম্ভিত-কিংকর্তব্যবিমূঢ়। রিসিভার সহ হাতটা কাঁপছে, কোথাও কি কোন ভুল হচ্ছে? আমি চারদিকে তাকাই, না, আমিতো কর্মস্থলে, আমার হাতে টেলিফোনের রিসিভার। কিন্তু আমার কণ্ঠ রুদ্ধ কেন? গলা থেকে কোন আওয়াজ কেন বেরুচ্ছেনা! আবারো একই কণ্ঠ,“ হ্যালো, আমি মাধবী বলছি।” অতি কষ্টে উত্তর দিতে গলাটা ভীষণ রকম কেঁপে গেল,“ মাধবী! আমি শুনছি মাধবী।” এই একটি কণ্ঠের অপেক্ষায় লাখো প্রহর কেটে গেল আর আমি কিনা তা শুনতে পাবোনা – তা কি করে হয় মাধবী! মাধবী বলে, “কাল সন্ধ্যায় শাহবাগে বইয়ের দোকানে এসো।” এতদিন পর তাহলে মাধবী ফিরলো। কোথায় ছিল এতদিন, কেনইবা চলে গিয়েছিল? আমার ফোন নাম্বারই বা পেল কি করে? এত সব ভাবনায় আমার কাজ কি?

পরদিন সন্ধ্যায় আমার রিক্সাটা পঙ্খীরাজের মতো হাওয়ায় উড়ে চলে শাহবাগের দিকে, গন্তব্য আজিজ সুপার মার্কেট-বইয়ের দোকান। মাধবী কি এসেছে? হ্যা, মাধবী এসেছে। ঐতো মাধবী দোকানে বইয়ের দিকে ঝুঁকে আছে। দুরু দুরু বুকে কাছে যাই। আচমকা মাধবী আমার দিকে তাকায়। ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কি বলে দিয়েছিল-আমি এসে গেছি? মাধবীর ঠোঁটের কোনে সেই অতি পরিচিত হাসি, আমি কিছু বলার আগেই সে বলে,“ চলো বেরিয়ে পড়ি।” আজিজ মার্কেট থেকে বেরিয়ে শাহবাগের দিকে হাঁটতে থাকি। মাধবী হাত বাড়িয়ে দেয়, আমি কম্পিত হাতে তা মুঠোবন্দী করি। কেউ কাউকে বলিনি কোথায় যাব, অথচ যেন চির চেনা পথে হেঁটে আমরা চারুকলার বকুল তলায় এসে থেমে গেলাম। আমি অপরিসীম মুগ্ধতায় মাধবীর দিকে তাকিয়ে থাকি। মাধবীও আমার চোখে চোখ রাখে।

হঠাৎ মাধবীর কথায় সম্বিৎ ফিরে পাই, “কি সৌভাগ্য বলো, কাল সকালে এয়ারপোর্টে নেমে সারাদিন আমি হণ্যে হয়ে বিভিন্ন দিকে ঘুরছিলাম-যদি তোমার দেখা পাই। কতটা বোকা ছিলাম আমরা যে কেউ কারো ঠিকানা জানতে চাইনি। যদি কাল অতনুর সাথে দেখা না হতো তোমার ফোন নাম্বার কি করে পেতাম?” সে আবার বলতে শুরু করে,“তোমার কাছে আমার অপরাধের শেষ নেই-কি করে আমাকে হঠাৎ যেতে হয়েছিল।”আমি মাধবীকে থামিয়ে দেই, “অপরাধ বলছ কেন? তুমিতো এসেছ, আর কোন কৈফিয়ত আমার চাইনা, আমার কাছে এসব মূল্যহীন মাধবী।” এটুকু বলার পর আর বেশী কিছু আমি বলতে পাচ্ছিনা, আমার কানে একটা শব্দই হাহাকারের মতো বাজছে- “এয়ারপোর্ট”। কম্পিত কন্ঠে বলি,“ তুমি কি আবার চলে যাবে?”

মাধবীর দুচোখ ক্ষণিকের জন্য অশ্রুসিক্ত হয়, তারপর ধীরে ধীরে সে উৎফুল্ল হতে থাকে, ঠোঁটের কোনে রহস্যের হাসি জাগিয়ে বলে, “যদি আর কখনো না যাই!” আমি শতভাগ আশ্বস্ত হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি, বুঝে যাই সে কি বলতে চায়। তবে তাই হোক মাধবী। তুমি আমার জীবনে সকালের সোনা রোদ হয়ে এসো, জোছনার বৃষ্টি হয়ে এসো, ভোরের শুভ্র শিশির হয়ে এসো। আমি দু’হাত প্রসারিত করি, মাধবী দ্বিধাহীন চিত্তে আমার আলিঙ্গনের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। খরস্রোতা কল্লোলিনী তার নির্মল জলে জ্বলন্ত কাঠের আগুন ধীরে ধীরে নিভিয়ে দিতে থাকে।

ঘরে ফেরা পাখিদের কোলাহল কানে বাজে। গাছের শাখার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দেয় চাঁদ। মাধবীর শরীরের ঘ্রাণ আর বকুলের গন্ধে আমার সকল ইন্দ্রিয় অবসন্ন হয়ে পড়ে। শিল্পীর ইজেলে সাঁটা হয় ক্যানভাস। আন্ লুইসের তুলির আঁচড়ে আাঁকা হয় ল্যুভর-এ সংরক্ষিত তার বিখ্যাত শিল্পকর্ম “দ্য স্লিপ অব এনডাইমিয়োন”


সংক্ষিপ্ত পরিচিতিঃ ছোট বেলা থেকেই বোহেমিয়ান এক জন মানুষ সৈয়দ মাহমুদ শিক্ষা জীবনে কিছু কিছু লেখা প্রকাশিত হয় স্মরণিকায়, সাহিত্য প্রতিযোগিতায় পুরস্কৃতও হনপেশাগত কারনে দীর্ঘ বিরতির পর আবার শুরু