Table of Content

Subrata Kumar Das
NA
NA
2 articles

হ্যারল্ড সনি লাডো

লেখক: সুব্রত কুমার দাস Category: প্রবন্ধ (Essay) Edition: Dhaboman - Eid 2018

হ্যারল্ড সনি লাডোর নাম-পরিচয়ে যাবার আগে কানাডীয় সাহিত্য বা ক্যানলিটে তাঁর অবদানের মূল্যায়ন নিয়ে বর্তমান প্রবন্ধটি শুরু করতে চাই। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত অধ্যাপক নিউ মাউন্টের  লেখা ‘অ্যারাইভাল : দ্য স্টোরি অব ক্যানলিটে’ গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে হ্যারল্ডের নাম ও বিস্তারিত ভূমিকা দেখে বর্তমান লেখকের আগ্রহ জাগে অভিবাসী অকাল প্রয়াত এই লেখকের সম্পর্কে। নিক লিখছেন ‘পূর্বের অন্যান্য সব কিছুর থেকে ভিন্ন কানাডীয় সাহিত্যের যে বিস্ফোরণ ঘটেছিল হারল্ড লাডো ছিলেন সেটির অবিচ্ছেদ্য অংশ’ (পৃ : ৫)।

ক্যারিবিয় লেখক হ্যারল্ড (১৯৪৫Ñ১৯৭৩) কানাডায় আসেন ১৯৬৮ সালে। দারিদ্র্যক্লিষ্ট হ্যারল্ড স্ত্রী-পুত্র নিয়ে টরন্টো বিশ^বিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য পড়তে এই বিদেশ বিঁভ‚য়ে পারি জমান। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘নো পেইন লাইক দিস বডি’। মহাজ্ঞানী গৌতম বুদ্ধের লব্ধ জ্ঞান ‘ঞযবৎব রং হড় ঢ়ধরহ’-কে আশ্রয় করে রচিত এই উপন্যাসের লেখক হ্যারল্ড ১৯৭৩ সালে দেশের বাড়িতে মায়ের সাথে দেখা করতে গেলে খুন হন। মৃত্যুর পর তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘ইয়েসটারডেজ’ প্রকাশিত হয়। টরন্টো বিশ^বিদ্যালয়ের মিসিসাগা ক্যাম্পাসে ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এর জন্য হ্যারল্ডের নামে একটি পুরস্কারও চালু আছে বর্তমানে।

হ্যারল্ড যখন খুন হন তখন তাঁর বয়স আঠাশ বছর। তার সাথে সম্পর্ক হয়েছিল সে সময়কার টরেন্টো পোয়েট লরিয়েট ডেনিস লী’র। নিক তাঁর বইতে শেষ অধ্যায়ে জানিয়েছেন, ১৯৭২ সালের নভেম্বরে হ্যারল্ড ডেনিসকে এক চিঠি লেখেন। তাতে বই বিক্রি না-হওয়া নিয়ে তার হতাশার কথা ছিল। তিনি এমনটিও জানিয়েছিলেন এইসব ফালতু লেখালেখি বাদ দিয়ে তিনি জন্মভূমিতে ফিরে যাবেন। নিকের ভাষায়, ‘কিন্ত উল্টোভাবে তিনি আরও বেশি লিখতে থাকেন। হ্যারল্ড নিজেকে এমনভাবে প্রশিক্ষিত করে তোলেন যে কয়েক ঘণ্টা ঘুম শেষেই তিনি নিজেকে বেডরুমে বন্দী করতে পারতেন এবং যতক্ষণ না একটি লেখার পাণ্ডুলিপি শেষ হতো নিজেকে নিবিষ্ট রাখতেন। এরপর তিনি ডেনিস লী বা পিটার সাচকে (জন্ম ১৯৫৩) ফোন দিতেন। জানাতেন তাঁর সদ্য সমাপ্ত লেখার কথা। এবং নতুন আরেকটি লেখায় নিবিষ্ট হতেন। তিনি বলতেন তিনি গোটা পঁচিশেক উপন্যাস লিখে ফেলবেন। সংখ্যাটি ত্রিশ বা পঞ্চাশেও পৌঁছাতে পারে। তিনি বলতেন বিংশ শতাব্দীর শুরুর কালের ত্রিনিদাদের জীবন থেকে শুরু করে ১৯৭০-এর দশকের টরন্টো পর্যন্ত তিনি চিহ্নিত করবেন (পৃ : ২৮১)। পরের পৃষ্ঠায় নিক জানাচ্ছেন গোটা দশেক উপন্যাসের খসড়া পাওয়া গিয়েছিল তাঁর মৃত্যুর পর।

ডেনিস লী অকাল প্রয়াত বন্ধু হ্যারল্ডকে নিয়ে দীর্ঘ এক কবিতা লিখলেন। ১৯৭৬ সালে সেটি ‘দ্য ডেথ অব হ্যারল্ড লাডু’ নামে পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়। রাইটার্স ইউনিয়ন অব কানাডার প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য, কানাডীয় সাহিত্যের বর্তমান বিকাশের শুরুর ব্যক্তিত্ব কবি ও লেখক পিটার সাচ  লিখলেন দীর্ঘ এক রচনা। প্যানক্যারিবিয়ান ডট কমে বর্তমানে লভ্য সে রচনাটির নাম ‘দ্য শর্ট লাইফ অ্যাণ্ড সাডেন ডেথ অব হ্যারল্ড লাডু’।

পিটারের লেখার মধ্যে অনেকগুলো ইঙ্গিত আছে। যেমন: সম্ভবত হ্যারল্ড পিতৃমাতৃ পরিচয়হীন। এবং সেটির পেছনের কারণ সম্ভবত দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ। হ্যারল্ড বড়ো হন ত্রিনিদানের ‘লাডু’ গোষ্ঠীর মানুষদের সাথে। লাডুরা ছিলেন অধিকাংশই ভারত থেকে আসা দাস শ্রেণির মানুষ। পিটার আরও জানিয়েছিলেন হ্যারল্ডের গলায় বিশাল একটা কাটা দাগ ছিল। এসব কথা বর্তমান রচনায় এজন্যেই উল্লেখ করা হচ্ছে যে হ্যারল্ডের জীবন ছিল সংঘাতময়, দারিদ্র্যক্লিষ্ট। আর সে কারণেই ওর উপন্যাসের পুরো প্রেক্ষাপটের ভেতরে ছিল দারিদ্র্যের কশাঘাত Ñ বেদনার নীল দংশন।

হ্যারল্ড টরন্টোতে আসার আগেই বিয়ে করেন। ওর স্ত্রী র‌্যাচেল সিং হ্যারল্ডের চেয়ে পাঁচ-ছয় বছরের বড়ো ছিলেন। র‌্যাচেলের প্রথম ¯^ামী খুন হলে পরে হ্যারল্ডের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। তখন র‌্যাচেল দুই সন্তানের মা। বিয়ের পর র‌্যাচেল ও হ্যারল্ডের আরও দুটি সন্তান হয়। পিটারের লেখার ভেতরে ফুটে উঠেছে হ্যারল্ডের সাথে তাঁর প্রথম সাক্ষাতের কথা, প্রাসঙ্গিক অন্যান্য কথাও। উঠে আসে হ্যারল্ড লাডুর অতীত লেখালেখির কথা।

লেখক হ্যারল্ডকে ভর্তি করানো হয় পড়াশোনার জন্য। উদ্যোগ নেওয়া হয় ওর লেখালেখি ছাপানোর। পিটার জানিয়েছেন ওর কবিতা দেখে তিনি বুঝতে পারেন সেগুলোতে ভিক্টোরিয়ান ইংরেজির ছাপ। শেষে ওকে ওর লেখা গদ্য নিয়ে আসতে বলেন। হ্যারল্ড নিয়ে আসেন গুটি কয়েক। জানান সেগুলো তিনি লিখেছেন পিটারের সাথে শেষ সাক্ষাতের পর। বাকিগুলো খবর জানান হ্যারল্ডের স্ত্রী। তিনি জানান, সে তাবতকাল পর্যন্ত হ্যারল্ড মোট দুই সুটকেস পাণ্ডুলিপি জমিয়েছিলেন। শেষ সাক্ষাতের পর কয়েকঘণ্টা ধরে সেগুলোকে পুড়িয়েছিলেন তিনি।

টরন্টোর বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা আনানসি থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ‘নো পেইন লাইক দিস বডি’। ত্রিনিদাদের প্রেক্ষাপটেই রচিত সে উপন্যাস। মুখ্য চরিত্র বারো বছরের বলরাজ। অভুক্ত, অর্ধভুক্ত বলরাজ আর তার চারপাশের চিত্রকেই হ্যারল্ড এই উপন্যাসে ধরেছেন। পিটার আর ডেনিস এই ইঙ্গিতটিই হ্যারল্ডকে দিয়েছিলেন Ñ নিজের কথা লেখ, নিজের দেখা জগতের কথা, মানুষদের কথা, সময়ের কথা।’ নো পেইনের শুরুর লাইনগুলোর বাংলা এমন Ñ ‘বাবা ঘরে এলো। মার সাথে কথা বললো না। এলো যেন সাপের মতো সন্তর্পনে।’ চার ভাইবোনের একজন যে বলরাজ - ক্লিষ্ট কিশোর এক - তার কথাই শুনতে শুনতে আমরা আসলে হ্যারল্ড ল্যাডুর কথাই যেন শুনতে থাকি।

এরই মধ্যে এক সময় হ্যারল্ড বই লেখার জন্যে সরকারি অনুদান পেয়েছেন। কিন্তু পেতে না পেতেই ডাক আসে ত্রিনিদাদ থেকে। বাবা অসুস্থ। একগাদা দুঃখকষ্টের ভেতর স্ত্রী আর সন্তানদের রেখে হ্যারল্ড দৌড়ালেন ত্রিনিদাদ। বাঁচাতে পারলেন না বাবাকে। ফিরতে ফিরতে অনুদানের টাকা শেষ। নতুন পাণ্ডুলিপিতে যখন ডুবছেন আবার সংবাদ এলো রাস্তায় রাস্তায় মা ভিক্ষা করে জীবন কাটাচ্ছেন। আবারো সব গুটিয়ে হ্যারল্ড দৌড়ালেন। এর এক সপ্তাহ পর একদিন গভীর রাতে পিটারের ফোন বেজে উঠলো। ফোন শুনেই তিনি বুঝলেন হ্যারল্ড হয়তো ফিরে এসেছেন। কিন্তু ফোনটা ছিল হ্যারল্ডের স্ত্রী র‌্যাচেলের। তিনি জানান যে, ত্রিনিদাদে তাকে হত্যা করা হয়েছে।

২০১৩ সালে হ্যারল্ডের প্রথম উপন্যাসটির নতুন সংস্করণ বেরিয়েছে। প্রচ্ছদে ইয়া লম্বা এক সাপ। নতুন সংস্করণের ভূমিকা দিয়েছেন ডেভিড ক্যারিয়ানডি। উল্লেখ করা যেতে পারে ২০০৭ সালে পঞ্চাশ হাজার ডলার অর্থমূল্যের রাইটার্স ট্রাষ্ট ফিকশনে প্রাইজটি ডেভিড পেয়েছেন তাঁর ‘ব্রাদার’ বইটির জন্যে। এর আগে উপন্যাসটির ২০০৩ সালের সংস্করণের ভূমিকা লিখেছিলেন ডিয়োন ব্রান্ড। বলে রাখা প্রয়োজন যে ডিয়োন হলেন টরেন্টোর তৃতীয় পোয়েট লরিয়েট যিনি ২০০৯ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন। ডিয়ানোর জন্মও ক্যারিবিয়ান দেশে। ডিয়োন ১৯৭০ সালে টরেন্টোতে অভিবাসী হন। ভূমিকাতে ডিয়োন জানিয়েছেন টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউঅবটি) এরিনডেল কলেজে তাঁরা সহপাঠী ছিলেন। আরও জানান কলেজে হ্যারল্ডের নাম ছিল ‘প্লেটো’। কলেজ ক্যাফেটেরিয়ায় হ্যারল্ডের সাথে অন্যান্যদের তর্ক-বিতর্কের একটি চিত্রও দিয়েছেন ডিয়োন। জানা যায় বন্ধুদেরকে হ্যারল্ড বলতেন যে, তিনি ভি এস নাই পলের চেয়েও ভালো একজন লেখক।

হ্যারল্ডের প্রথম উপন্যাসের  কাহিনি শুরু ১৯০৫ সালে। ক্যারিবিয়ান টোলা ট্রেস জেলায়। আগেই বলা হয়েছে উপন্যাস প্রধান চরিত্র বালরাজের কথা। বালরাজ সবার বড়ো। এরপর বোন সুনারী, পরে যমজ দুজন Ñ বাম এবং পান্ডে। চার ভাইবোনের এই যে সংসার যেখানে ক্লিষ্ট বাবা-মা, সেই গল্পতে হ্যারল্ড বারবার নিয়ে আসেন সাপের ছায়া।

ভাবতে ভালো লাগে ১৯৭২ সালে প্রকাশিত ইংরেজি উপন্যাসে হ্যারল্ড কানাডায় বসে কত সহজেই চধ (বাবা), গধ (মা) অর্থে ব্যবহার করেছেন তার উপন্যাসে। কত সহজেই মুখের কথার ইংরেজিকে বানান এবং বাক্যগঠনে বদলে দেন তিনি। কত সহজেই কানাডীয় প্রেক্ষাপটে বসে তাঁর উপন্যাসে ভারতীয় পৌরাণিক চরিত্রকে ছায়া করে ফেলেন তার নিজের উপন্যাসে।

হ্যারল্ডের জীবন নিয়ে, তাঁর সাথে সংযোগ নিয়ে ডেনিস লী’র কবিতাটি কুড়ি পৃষ্ঠা দীর্ঘ। ডেনিস শুরু করেছেন পাঁচ বছর আগে তাঁদের প্রথম সাক্ষাৎকার দিয়ে। আকারে ইঙ্গিতে ডেনিস অনেক কথা জানিয়েছেন। বলেছেন হ্যারল্ডের পাণ্ডুলিপি পুড়িয়ে ফেলার কথা। একসাথে পান করার কথা, লেখালেখির কথা, বাঁচা-মরার কথা।

ষাটের দশক থেকে কানাডীয় সাহিত্যের স্বকীয় যে বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল হয়ে নাম নিয়েছিল ‘ক্যানলিট’ সেটির শুরুর দশকগুলোর নির্মাতাদের একজন ছিলেন হ্যারল্ড লাডু। অন্যের চোখে নয়, নিজের চোখে দেখা; অন্যের জগত নয়, নিজের জগতের বর্ণায়নে সে জোয়ার উনিশ শ সত্তরের দশকে শুরু হয়েছিল কানাডায় Ñ হ্যারল্ড ছিলেন তাঁদের অগ্রদূত। অভিবাসীর দেশ কানাডায় অভিবাসী লেখকও যে নিজের কথা লিখতে পারেন, এবং নন্দিত হতে পারেন, এই সত্যের প্রথম বিজয় তিলক সূচিত হয়েছিল হ্যারল্ডের প্রথম উপন্যাস দিয়ে। আর হয়তো সে কারণেই টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক বিশিষ্ট সাহিত্য সমালোচক নিক মাউন্ট তাঁর সুখপাঠ্য গবেষণা গ্রন্থ ‘অ্যারাইভাল’-এর প্রচ্ছদেও মার্গারেট অ্যাটউড এবং আরও কয়েকজনের সাথে ব্যবহার করেছেন তী² চোখের চোয়ালভাঙ্গা ছোটো গোফের ধূমপায়ী হ্যারল্ড সানি লাডুর ছবি।