Table of Content

Mafia Mollik
NA
NA
2 articles

আব্বু; কি জানি কিসের লাগি প্রান করে হায় হায়

লেখক: মাফিয়া মল্লিক Category: প্রবন্ধ (Essay) Edition: Dhaboman - Eid 2018

আব্বু

 

ছোটবেলার বাবা বলতে গল্প উপন্যাসে যেমন একা চরিত্র উঠে আসে, যিনি বিকেলে বাড়ি ফিরে সন্ধ্যায় ছেলেমেয়েদের পড়াতে বসেন, শুক্রবার তাদের হাত ধরে জুম্মার নামায পড়তে যান, মা বরাবর যাঁর ভয় দেখান ‘বাবা আসুক আজকে’।
আমাদের আব্বু রা তেমন ছিলো না। 
আমার কাছে খুব ছোটবেলায় আব্বু ছিলো কমব্যাট ইউনিফর্ম, বুটজুতো, পিতল পালিশের গন্ধ আর খুব ভোরে উঠে ক্যাসেট প্লেয়ারে বাবার বাজানো চিত্রা সিং এর গান। কি আশ্চর্য, আব্বুর স্মৃতি ঝাপসা হলেও গানগুলোর কথা সুর সব মগজে গেঁথে আছে।
আব্বু কে ভয় পেতে হয় জানতাম না, কারন ভয় পেতে হলেও একটা পরিচিতি গড়ে উঠতে হয়, আমার আব্বু কে ততক্ষন কাছে পেতাম কই ! সকালে ঘুম থেকে ওঠার আগেই আব্বু অফিসে, ফিরবে রাতে আমি ঘুমানোর পর।
একটু বড় হবার পর বুঝলাম আব্বু হলো আহ্লাদের জায়গা। আমার যখন বয়স তিন বছর, আব্বু একদিন নিয়ে আসলো সাতাশটা শিশুদের বই, সেই আমার বই পড়া শুরু। এরপর আব্বু মানে ইয়ামাহা মোটরবাইকের সামনে বসে চাইনিজ খেতে যাওয়া আর চামচ কাঁটা ছুরি ধরতে শেখা, কোলে রুমাল পেতে চেয়ারে বসে খাওয়ার ডাইনিং এটিকেট শেখা। আরেকটু বড় হয়ে যখন ক্লাস টু থ্রি, তখন এক ঘর মেহমানের সামনে বলতাম ‘আব্বু বলোতো কোন ক্লাসে পড়ি ?’ শ’আটেক লোকের দায়িত্বে থাকা আব্বুর কেন যেন এই হিসাব টা মনে থাকতো না।
আব্বু বছরে দুবার মাসখানেকের জন্য নাই হয়ে যেত, এক্সারসাইজ, ফায়ারিং এর মতো শব্দগুলো বুঝতাম না, আব্বু ফিরতো রোদে পুড়ে বৃষ্টি তে ভিজে কালো হয়ে, চেনাই যেতো না।একবার শুনলাম চিটাগং বলে একটা জায়গায় যায় আর সেখানে সাইকেল পাওয়া যায়। মাসখানেক অজ্ঞাতবাস থেকে ফেরার পথে আব্বু এনেছে সেই লাল সাইকেল, আমি তখন পাঁচ কি ছয়। এই সাইকেলে উড়ে বেড়ানোই আমার শৈশব।
ঈদের দিন নতুন জামা জুতোয় সেজে আব্বুর সাথে বড়খানা খেতে যাওয়া এক গল্প। কিছুতেই বুঝতাম না আব্বু কেন গাড়ী থামিয়ে প্রতিটা চেকপোস্টে এমপি দের সাথে কোলাকুলি করতো। কোয়ার্টার গার্ড পেরোনোর সময় হুঙ্কার দিয়ে সম্মিলিত স্যালুট টা বাবার জন্যই, জানতাম খুব সিরিয়াস ব্যাপার বটে। বিকেলে বিউগল বাজলে যেখানেই থাকো চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, নিয়ম। আর্টিলারি অফিসার আব্বু নিয়ে যেত মিডিয়াম গান (কামান) দেখাতে, সেই ছোট্ট আমি পুতুল খেলা বাদে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলি তখন থেকেই। 
গাড়ীর প্রতি আব্বুর ভালোবাসা অসীম। আব্বুর খুব অহংকারের গল্প, আব্বুর ইউনিটে জিওসি ইন্সপেকশনের সময়, ইউনিটের গাড়ীর রেডিয়েটরে আঙ্কেল নিজের রুমাল আঙুলে পেঁচিয়ে রেডিয়েটর পরীক্ষা করে ধবধবে পরিস্কার রুমাল সবাই কে দেখিয়ে বলেছিলেন ‘this is Artillery’ !
আব্বু মানে গাড়ী চালানো শিখতে গিয়ে প্রথম বকা খাওয়া, আব্বু মানে পয়েন্ট টুটু রাইফেল ফায়ারে হাতেখড়ি, আব্বু মানে জোরে জোরে তেলাওয়াত করে নামায পড়া আর সেখান থেকে আমপারা’র সব সুরা শিখে ফেলা, বাসায় সাপ ঢুকেছে আব্বু লাঠি দিয়ে মেরে দিয়েছে, শেয়াল মুরগী খেতে এসে ভয় দেখিয়েছে আব্বু গুলি করে মেরেছে, আব্বু মানে নিশ্চিন্তি - মা বকবে না আজ।
বছরে একবার ছুটিতে দাদাবাড়ি নানাবাড়ি যাওয়া, সে এক সময় যখন আব্বুর মুখে অদ্ভুত হাসি দেখতাম। সাধারন বাসে ট্রেনে যাত্রা, আরিচা-নগরবাড়ী ঘাটে সেই জন্মের লেট হতো। ফেরি আসলে বাস ফেরিতে ওঠা ছিলো বিশাল ঝক্কি, আব্বু সহ সব ছেলেদের নেমে যেতে হতো বাস থেকে, আমার শুরু হতো জন্মের কান্না ! এতো বাস ফেরি কাদা পানির মাঝে আব্বু কিভাবে আমাদের খুঁজে পাবে ?
আব্বু আমি এখন এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশ ঘুরে বেড়াই একা, মরনাপন্ন রোগীর চিকিত্সা করি, বড় বড় প্রফেসরদের কাজে সাহায্য করি। কিন্ত এখোনো, যখন বড় কোন সমস্যায় পড়ি, চোখ বন্ধ করলে আমি চলে যাই আরিচা ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকা কোন বাসে, অস্থির হয়ে কাঁদতে থাকি আব্বু আব্বু বলে।
কারন আমি জানি, আমার আব্বু মানেই মুশকিল আসান।

 

কি জানি কিসের লাগি প্রান করে হায় হায়:

 

Domestication Syndrome বলে বিবর্তনে একটা ধাপ আছে। বন্য জন্তু যখন বেশ কয়েক পুরুষ ধরে মানুষের পোষ্য হিসেবে থাকে , তখন তাদের বেশ কিছু শারীরিক ও আচরণগত পরিবর্তন ঘটে। যেমন বন্য কুকুর বেড়ালের খাড়া কান নেতিয়ে পড়ে, পশমের রঙ ম্লান হয়ে আসে, খাড়া নাক ছোট হয়ে আসে। কারন মানুষের সাথে থাকার কারনে তাদের সর্বদা উৎকর্ন হয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয় না। তাদের শরীরে এড্রেনালিন নামক বিশেষ হরমোন নি:সরন কমে যায়, ফলে তাদের আচরন ও বন্য থেকে শান্ত হয়ে ওঠে। সবটাই ঘটে নিউরাল ক্রেস্ট নামের কিছু দেহকোষের বিবর্তনে।

বিবর্তনে না হলেও আপাত দৃষ্টিতে মানুষেরও Domestication ঘটে, বিশেষ করে মেয়েরা যখন মহিলা হয়ে ঘর সংসারে জড়িয়ে রান্নাঘর, কাজের লোক আর হিন্দি সিরিয়ালে হারিয়ে যায়, বিপুলা পৃথিবীর অন্য কিছুতে তাদের আগ্রহ থাকে না।
একসময় আমি নিজের জন্য সময় আলাদা করতাম, প্রিয় লেখকের বই হাতে কফিশপে কিছুক্ষন সময় কাটিয়ে আসতাম, একা। ভরদুপুরে একান্ত পছন্দের মুভি দেখতাম চায়ের কাপ হাতে। এইসব কিছু আমাকে ভীষন ভাবে উজ্জীবিত করতো, সতেজ করতো।

আমার domestication ঘটতে শুরু করলো।

বাচ্চা সামলে আর কিছু করার ইচ্ছেটাই চলে গেল। ভুল বুঝবেন না, বাচ্চা সংসার ইত্যাদি আমার ওপর চাপ ছিলো না। আমি নিজেই চাইতাম বাচ্চার সাথে সময় কাটাতে। আর তখন ঢাকা শহরে ছোট বাচ্চা নিয়ে যাওয়ার জায়গায় বা কোথায় ! আমি ঘরকুনো হয়ে গেলাম। আমার পৃথিবী সন্তানময়, ধুলো জমতে থাকে বইয়ের মলাটে, হাত পড়ে না মিউজিক সিস্টেমে, টিভি তে চলে শুধু কার্টুন।তানপুরার ছেঁড়া তার মেরামত হয় না, বাক্সবন্দী হারমোনিয়াম, রেডিও প্রোগ্রাম ছেড়ে দিয়েছি, লিখি না কোথাও বহুদিন।

বাচ্চা স্কুলে যাওয়া শুরু করার পরেও তেমন হেলদোল ঘটেনি, তখন ভীনদেশে নতুন সংসার, জামাইয়ের নতুন চাকরী পড়ালেখা, আমি সংসার গোছানোর নামে বিছানার চাদর পাল্টাই, রান্নার নামে নতুন সব মশলা কিনি, নিত্যকার রান্না খাওয়া ধোয়া মোছা অভ্যাসগত রমনে দিনগত পাপক্ষয় করে মোক্ষলাভের চেষ্টা করি। পড়ালেখায়, অফিসে ইঁদুর দৌড় ক্লান্ত আমাকে আরও ভীষন ভীষন ক্লান্ত করে তোলে।

হঠাৎ, একদিন, কেন যেন মনে পড়ে, এই যে এইটা, এইটা ঠিক আমি না। আমার আমি কে এক দীর্ঘ শীতনিদ্রায় ঘুম পাড়িয়ে আমার ছায়া ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে।

আমি ছিলাম উচ্ছল, প্রানবন্ত, রঙীন বুদ্বুদের মতো। অনবরত হাত নেড়ে বকে যাওয়া কিশোরী, যার হাসি আর কথা অতিষ্ঠ করে ছাড়তো বাসা স্কুল কলেজে সবাইকে।পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম বিষয়েও যার ছিল প্রবল আগ্রহ, সারারাত পরীক্ষার পড়া পড়েও সকালে দু’পাতা গল্পের বই না পড়লে যার ঘুম আসতো না।
আয়নায় দেখলাম এক মাঝবয়সী মহিলার মুখ। স্থুলকায়া, চোখের কোলে কালির পোঁচ, চোখ হারিয়েছে দ্যুতি, রাজ্যের ক্লান্তি চিবুকের খাঁজে, চুলের ভাঁজে রুপোলি ঝিলিক।

চমকে যাইনি, এমনটাই ভেবেছিলাম।

সময় নিলাম। ভাবলাম, আমি কি চাই। ভালোই তো আছি। Aging gracefully. মধ্যবয়স তো আসবেই, তারুণ্য কি চিরকাল থাকে? কেটে গেলো আরো কিছুদিন।

কিন্ত কেন যেন শেষ চৈত্রের বাতাসে আবার মনটা হু হু করতে লাগলো, গুটিয়ে রাখা গল্পের বইয়ের বাক্স খুলে গুছিয়ে রাখলাম একদিন, ভরদুপুরে চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে আবার দেখলাম অপর্ণার ‘পারমিতার একদিন’, ঘুমাবার আগে ফ্রেন্ডস রি-রানের বদলে আবার দেখলাম Eat Pray Love.
এ যেন ফুলের মেলায় মৃদু বাতাসে বসে এক অচিন মনকেমন, ‘কি জানি কিসের লাগি প্রান করে হায় হায়’।

বুঝতে পারলাম সময় হয়েছে। তৃষিতের মতো অপেক্ষা করতে লাগলাম আমার নিজের জন্য, শর্বরীর প্রতীক্ষা।কোন এক প্রস্তর যুগে চাপা পড়া মহাকালের মতো গভীর শীতনিদ্রা ভেঙে জেগে উঠছিলাম আমি।

নিজের ভবিষ্যতের কাছ থেকে অতীতের নিজেকে ফিরে পেতে চাওয়া অলীক কল্পনা নয়।ফিরে যে পেতেই হবে এমন ও কোন কথা নেই। তবে নিজেকে সময় দিন। তারুণ্যে থাকুন কি প্রৌঢ়ত্বে, উপভোগ করুন এই অদ্ভুত সুন্দর পৃথিবীতে আরো আশ্চর্য সুন্দর জীবন কে।

ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।