Table of Content

Rina Gulshanara
NA
NA
5 articles

অবিশ্বাস

লেখক: রীনা গুলশানারা Category: ছোট গল্প (Short Story) Edition: Dhaboman - Eid 2018

আকাশ আজ মেঘলা ! বাতাসের প্রকোপটাও যথেষ্ট এলো মেলো ! ওর বাসাটা লেকের পাড়ে হওয়াতে স্বভাবতই বাতাসের তান্ডবটা সর্বদা খুব বেশী থাকে ! তবু লাবন্যের মনটা আজ খুব ভালো হয়ে আছে ! হঠাৎ পাওয়া এই ,  "গুড ফ্রাইডে " যে এর কারন তাতে কোন সন্দেহ নাই ! কারন লাবন্যের কর্মস্থলে বৎসরে মাত্র তিন্ দিন ছুটি থাকে ! তাই লাবন্য আজ খুশী , খুউব খুশী ! খুব ভোরে উঠেই , ব্যালকনিতে যেয়ে সকালের তাজা রোদ গায়ে মাখালো আর ভোরের লেকের টলটলে পানিতে সূর্যের দোলা দেখলো , যা তার আদৌ দেখাই হয় না ! এরপর ঘরের টুক্ টাক কাজ করলো ; এবং ফ্রিজ ভর্তি রান্না করা খাবার থাকা সত্বেও আবার পারশে মাছের চচ্চড়ী করলো বেশী করে কাচা মরিচ আর ধনে পাতা দিয়ে ! ঘরে কম্পিউটারে গেম খেলায় ব্যস্ত ছেলেকে একটু পর পর এটা ওটা খাবার দিয়ে আসা , আর বুকে চেপে ধরে আদর করা ! অতপর বহুদিন পর সম্ভবত বছর পাচেঁক পর টিভি তে বাংলা নাটক দেখতে বসলো ! নাটকের নাম আকাশের ওপারে আকাশ ! নাটক দেখা শেষ করে আজ হঠাৎ মন চাইলো , অনেক দিন ধরে কথা বলে না এমন কারো সাথে কথা বলতে ! ফোন বুকে খুঁজতে শুরু করলো ! একটি নামে দৃষ্টি আটকে গেল,তটিনী ! হা অনেকদিন তটিনীর সাথে কথা বলা হয় না ! লাবন্যের স্কুল জীবনের বন্ধু ! এক সাথে ওরা "গার্লস গাইডে " এও ছিলো ! স্কুলের সেই দুরন্ত ,উদ্যম আর উচ্ছাস ভরা জীবনের সাথে তটিনী বড়ই একাত্ব ছিলো ! এক্ সাথে গান গাইতো ,খেলতো পিকনিকে যেতো ! এমন কি স্কুলের বাৎসরিক ফাংশানে তারা নাটকও করেছে ! টরেন্টো তে এসে বছর খানেক পর একজন কমন বন্ধু র মাধ্যমে জানতে পারলো ,তটিনী বছর পাঁচেক ধরেই টরেন্টোতে আছে ! অথচ , লাবন্য জানতো তটিনী এখনো অবধি "মিডল ইস্টে " ই আছে !

যাইহোক টেলিফোন নাম্বার যোগাড় করে একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়লো , নাম্বার লাগতেই উচ্ছসিত লাবন্য প্রায় চিৎকার করে তার উচ্ছাস প্রকাশ করলো ! ওপাশে তটিনীও প্রথমে কিছুটা থমকে তারপর তারো সমান উচ্ছাস !

: ওহ মাই গড !আই কান্ট বিলিভ , তুই কোথা থেকে ? কবে এলি এখানে ? আমার নাম্বার কোথা থেকে পেলি ?

তটিনীর হাজারো প্রশ্নবানে লাবন্য বল্লো : আরে সব বলবো, কতদিন তোকে দেখিনা রে, তুই বরং চলে আয় আমাদের বাড়ী , আমাদের আবার গাড়ী নাই তো !

: ওহ সিওর ! গিভ মি ইউর এড্রেস !

 যাই হোক অনেকক্ষন আলাপ চারিতায় লাবন্যের যেমনি ভালো লাগায় মনটা ভরে যাচ্ছিলো , আবার অন্য আর একটা মনে এবং কানে যেখানে ( চিরকালের ভীষন সাধাসিধা বাঙ্গালী অনুভবটা বারবার আহত হচ্ছিলো ) ! কারন তটিনী আশি ভাগ সংলাপ ইংরেজীতে বলছিলো ! এমনিতে লাবন্য বাঙ্গালীদের নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় কখনো ইংরেজী কে মাধ্যম করে না ! কারন এই বাংলা ভাষার জন্য সাত খন্ড রামায়ন ! ৫২ এর ভাষা আন্দোলন ! ৭১ এর গন হত্যা ! তবু ভুলে যায় মানুষ , ছোঁয়াচে বাংগালী ! বিশেষত এই রকম ইংরেজী বলতে শুনলে ওর মনটা একেবারে তিক্ত হয়ে যায় ! যাইহোক , তটিনীর গাড়ী থাকা সত্বেও "এই আসছি " "এই যাবো " করে করে একটি বছর গড়িয়ে গ্যালো ! তবু তটিনীর আর আসা হলো না ! মাঝে মধ্যে অবশ্য ফোনালাপ হয় ! এর মধ্যেই একটা অপ্রত্যাশিত যোগাযোগ হয়ে গ্যালো ! হঠাৎ করেই দেশ থেকে ওর কাজিন অমিতা এলো কানাডাতে ইমিগ্রান্ট হয়ে ! তটিনী যে বিল্ডিং এ থাকে , কাকতলীয় ভাবে সেই একই বিল্ডিং এ! দেশ থেকে আসবার সময়ই অমিতা দু মাসের প্রেগন্যান্ট ছিলো ! এসেই তাই অমিতা খুবই অসুস্থ হয়ে পড়লো ! লাবন্য তাই এক রবিবারে প্রচুর রান্না করে ওর কাজিন কে দেখতে গ্যালো ! সাথে তার স্বামীও ছিলো ! ওখানে যাবার পর কথা প্রসঙ্গে অমিতা আর সাগর (লাবণ্যর স্বামী ) কে বল্লো , তটিনীর কথা! অমিতা বল্লো ,আমাদের বিল্ডিংয়েই থাকে ! এবং তটিনীর ব্যাপারে অনেক গল্পও করলো ! শেষে বল্লো , আপু যান না ঘুরে আসেন , কিছুক্ষনের জন্য ! অতপর লাবন্য , তটিনী কে ফোন করলো , এবং কিছু হাই হ্যালো করেই , বল্লো : আমি তোর বিল্ডিং এর ১৯ তলাতেই আমার কাজিনের বাসায় বেড়াতে এসেছি ! শুনলাম তুই এই বিল্ডিং এই থাকিস !

তটিনী  সোৎসাহে বললো : বলিস্ কি তুই এখানে ? জলদি চলে আয় !!

আর কতকাল পরে তটিনীকে দেখবে বলে লাবন্যের মনে বয়ে চলে স্মৃতির ঝড় ! একটু ছোটো খাটো ,শ্যামলা , কোমর পর্যন্ত নেমে আসা ঘন কালো কোকড়ানো চুল , আর ভীষন মিস্টি একটা মুখ , গভীর কালো চোখ ! খুবই চঞ্চল ,অকারনে হেসে গড়িয়ে পড়া ! বাক বাকুম করে কথা বলতো ! আর খুবই সিম্পল ছিলো ! অবশেষে ওর ঘরের দোরগোড়াতে দাঁড়িয়ে , দরজায় নক করলো ! সাথে সাথেই প্রায় দরজা খুলে দিলো ওর কন্যা ! ওদের লিভিং রুমে নিয়ে বসালো ! বেশ কিছুক্ষন পর স্বামী কে নিয়ে তটিনী বেড রুম থেকে বের হয়ে এলো ! লাবন্য আর সাগর দুজনই বিস্ময়ে দাড়িয়ে পড়লো ! তটিনী একদম বিদেশী ঢঙ্গে হাই বলে লাবন্য কে হাগ করলো তারপর দুই গালে গাল ছোয়ালো ! তারপর ইংরেজীতেই বল্ল , ওদের দেখে খুব খুশী হয়েছে ! তটিনী তার দুই কন্যা নিশা এবং দীশা র সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো ! পরিচয় করিয়ে দিলো তার স্বামী ইমতিয়াজের সাথে ! ইমতিয়াজ কে খুবই ভদ্র , শান্ত , এবং একই সাথে বেশ অসুস্থ মনে হলো ! তটিনী এরপর গল্পোচ্ছলে বল্লো , ইমতিয়াজ মুলতই অনেক অসুস্থ ! কিছুদিন আগেই তার ওপেন হার্ট সার্জারী হয়েছে ! লাবন্যের বিস্ময়ের ধাক্কা তখনও মোটেই কাটেনি ! তটিনীর কথা শুনছে আর স্মৃতির তটিনীর সাথে বর্তমানের তটিনীকে মিলাবার প্রানান্ত চেস্টা করছে !

কোথায় সেই পিঠ ছাপানো চুল? এখন সেটা কানের উপরে এসে ঠেকেছে অর্থা্ৎ বয় কাট ! আর পোশাক ?? রীতিমত লাবন্য ধাক্কা খেলো আগের তটিনী র কথা চিন্তা করে ! হাঁটু পর্যন্ত ঝুলের ড্রেস পরেছে আকাশী ছাপার ! ওর সেই ঢল ঢলে মিস্টি মুখটা , অতিরিক্ত মেক আপে খুবই রুক্ষ হয়ে গেছে ! আর দুই মেয়েই মাইক্রো হাফু আর উপরে স্লিভ লেস টি শার্ট পরা ! তবে এদের মধ্যে ইমতিয়াজকে আব্দুল্লাহর আলুর মত ( মুজতবা আলীর দেশে বিদেশে র ) মনে হচ্ছিলো ! একেবারেই বেমানান ! সে যেনো পুরোটা বাংলাদেশকে ধারন করে আছে ! তটিনী কে দেখার এতটা উচ্ছাসের মধ্যেও লাবন্য বার বার হারিয়ে যাচ্ছিলো ফেলে আসা সেই সব রোদেলা দিন গুলো তে ! যদিও সে জানে যে এটা অবান্তর ভাবনা ! ইতিমধ্যে মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়েছে ! লাবন্যর দুই ছেলেও তাদের বাবার মাথা ছাড়িয়েছে ! উচ্চ শিক্ষিত , উচ্চ পদস্থ স্বামীর সাথে পৃথিবীর কত দেশ ঘুরলো , থাকলো , অবশেষে ছেলেদের উচ্চ শিক্ষার জন্য কানাডায় এসে থিতু হলো ! তবু এত কিছুর পরও লাবন্য তার নিজস্ব সত্তা কে জলাঞ্জলি দিতে পারেনি ! পারেনি তার ধার্মিক মনোভাব আর তীব্র বাঙ্গালিয়ানা কে বিসর্জন দিতে ! এখনও তার সাথে সাথে ফেরে হিজাব ! আবার রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা ! আর প্রতিদিন রবীন্দ্র সঙ্গীত না শুনলে তার নিজেকে আধুরা মনে হয় !এরই মধ্যে তটিনীর মার্জিত কিন্নর কন্ঠের ঝঙ্কার – :কিরে লাবন্য , তুইতো একটুও চেঞ্জ হস্ নি ! সেই হুজুরই রয়ে গেছিস ! শুধু শরীরেই যা বেড়েছিস !!

: তা আর বলতে ? এক্কেবারে ফুটবল !

: তা কাজ টাজ কিছু করছিস ?

: নারে ক্যাবোলই তো এলাম ! তবে একটা কোর্স করছি ! দেখি কদ্দুর কি করা যায়?

:তাই নাকি ? দ্যাটস গুড !!

: তা তুই তো মধ্য প্রাচ্যে বহুদিন ছিলি ! আবার কানাডাতেও অনেকদিন এসেছিস , তাওতো বছর দশেক ,তাইনা ! তা দেশে যাসনি ?

: অহ সিওর , আমি গিয়েছিলাম একবার মা কে দেখতে , আর একবার ভাই এর বিয়েতে ! আমি মেয়েদের নিয়ে গিয়েছিলাম ! তবে ইমতিয়াজ যায়নি কখোনো !

: সেকি রে ? ইমতিয়াজ ভাইয়ের মা বাবা নাই ?

:আছে ! বাবা অবশ্য অনেক আগেই গত হয়েছেন ! তবে মা আছে ! ওরা অনেক ভাই বোন ! আর ইমতিয়াজ খুবই প্রাক্টিক্যাল ধরনের মানুষ ! ডলার পাঠিয়ে দ্যায় ! এন্ড দে নিড মানি ! হোয়াট ইউ থিঙ্ক ? সে না গেলে তাদের কি কিছু আসবে যাবে ? বাট সুড বি গো মানি !

লাবন্য চকিতে একবার ইমতিয়াজের মুখোভাব অবলোকন করলো ! খুবই আশ্চর্য হয়ে  দেখলো , সেই মুখে পূর্ণ সম্মতি যা তার স্ত্রী এখুনি বললো ! লাবন্যের বুকের মধ্যে এক চোরা কষ্টের স্রোত বয়ে গেলো এবং সেই সাথে তীব্র একটা ক্ষোভও ! তটিনীরও দুইটি কন্যা ! তার কি দুই কন্যার প্রতি সম মনোভাব নাই ? সমান ভালোবাসা ? প্রতিটি বাচচা কেই জন্ম দেবার সময় একজন মা কি এক্ই 

জঠোর জ্বালা ভোগ করে না ? প্রতিটি সন্তানের জন্য সেতো একজনই মা ! হয়তো ইমতিয়াজের মা এক বুক যন্ত্রনা নিয়ে প্রতিরাত ... সারাবেলা পথপানে চেয়ে থাকে ,চোখের জলে বুক ভাসিয়ে ! হয়তোবা রাতের আকাশে প্লেনের শব্দে কান পেতে থাকে ...হয়তো এই প্লেনেই তার বুকের ধন আসবে আর তাকে জড়িয়ে ধরে বলবে -:মাগো ।।আমি এসেছি !! তটিনীর ভীষন যত্নে , নিপূন ঢং এ ছোট্ট ক্রিস্টালের বাটিতে দেওয়া হানিডিউ লাবন্যের কন্ঠের কাছে বিস্বাদের তেতো স্বাদে ভরে গ্যালো ! অতপর আরো কিছু সময় অতিবাহিত করে এক সময় "বাই " বলে বিদায় নিলো ! এসবই লাবন্য দের আসবার পরের বছরের ঘটনা ! এর মধ্যে অন্টারিও লেকের পানি অনেক গড়িয়েছে ! তটিনীর আর কখনো তার বাসায় আসা হয়ে উঠে নি ! মাঝে মধ্যে ফোন যে করেনি , তা নয় ! তবে তার মধ্যেও বেশ আন্তরিকতার যথেস্ট অভাব ছিলো ! তবে লাবন্য প্রায়শই ফোন করে হার্দিক কথা বার্তা বলেছে! এরি মধ্যে এক রবিবারে মধ্য দুপুরে ওদের একজন কমন বন্ধু আলোর টেলিফোন এলো –

:কি ব্যাপার লাবন্য কাল যে বড় এলি না ? আমাদের পরিচিত প্রায় সবাই এসেছিলো ...নিশার বিয়েতে।:নিশার বিয়ে ? কি বলছিস এসব ? আমিতো কিছু বুঝতেই পারছি না !

:সে কিরে ? কালতো নিশার বিয়ে ছিলো ? ক্যানো তটিনী তোকে কিছু বলেনি ?

: নারে ,আমি কিছুই জানি না ! : অবশ্য বলবেই বা কি ? তুই তো আবার বেশ কনজারভেটিভ টাইপের , তাই মনে হয় তোকে বলেনি !

: তাই নাকি? সেটা অবশ্য ওর নিজস্ব ব্যাপার !

: তা অবশ্য ঠিক ! তবে কিনা বিয়ে তো একটা ফরমালিটিস ছিলো , নিশাতো বহুদিন ধরেই " লিভিং টুগেদার " করছিলো !

:যাহ কি বলিস ?

: হ্যা রে আমরা সবাইতো জানতাম ! তবে তুইতো দূরে থাকিস তাই জানিস না !

: তা অবশ্য ঠিক ই বলেছিস ! আমার এক দু মাইল এর মধ্যে কোনো বাঙ্গালী নাই ! তারপর খুব ধুমধাম হলো ?

: নারে , জাস্ট দুই পরিবার একটু ধর্মীয় বিধানে দু হাত এক করে দিলো ! ছেলে অবশ্য বাঙ্গালী নয় !

: তাহলে ?

: পারসিয়ান !

এরপর আলোর সাথে কথা আর তেমন বাড়েনি ! এরপর ই লাবন্য , তটিনী কে খুব রেগে ফোন দিয়েছিলো ! যথারীতি তার আক্রমনের জবাবে ,তটিনীর স্মার্টলি জবাব : নারে লাবন্য , যা ভাবছিস তা নয় , উইদিন আ টু ডেইস ... সব কিছু করতে হলো ! কি করে যে কি হলো বুঝতেই পারলাম না ! এখানে আমাদের কিছুই করার ছিলো না ! নিশা আর মেহেদীর বহুদিন ধরেই এফেয়ার চলছিলো ! তারাই ডিসিশান নিলো হঠাৎ করেই , তারা বিয়ে করতে চায় ! এত্ত জলদি কিছু হয় বল ? তবু তারা চাইলো তাই খুব ঘনিষ্ট কিছু আত্মীয় নিয়ে বিয়ে টা দিয়ে দিলাম ! তেমন কোনো শপিং ও করিনি ! আমার গহনা দিয়েই বিয়ে দিয়ে দিলাম ! তোর ইমতিয়াজ ভাই তো কোনো কিছুর মধ্যেই ছিলো না !

: ক্যানো রে ?

:কারন মেহেদিরা ঠিক মুসলমান নয় ! :কি বলিস ?  কিন্তু তো আমি শুনলাম ওরা পার্সিয়ান  ?

:হা তা ঠিকই শুনেছিস ! তবে ওরা বাহাই ধর্মের !

এবারে লাবন্য আর কি ই বা বলবে ? তটিনীর সারেন্ডারের ভঙ্গিতে কথা শুনেই ,সে আর কিছুই বলতে পারলো না ! বরং তার মনে হোলো , তটিনীর কন্ঠে কিঞ্চিত ব্যথার সুর ! এরপর অবশ্য তটিনী নিজের মনেই অনেক কিছু বলে গেল!

: বুঝলি লাবন্য , বেশ কনফিউজড ছিলাম , অন্য দেশের , অন্য কালচারের না জানি ক্যামোন হবে ? তবে সে ভয় আর নাই রে ,মেহেদি খুবই সিম্পল টাইপের একটা ছেলে ! যখনি আসে আমার বাসায় , আমার পায়ে পায়ে ঘোরে ! যাই রান্না করি সোনা মুখ করে খাবে । যাই হোক লাবন্য রাগ করিস নারে ,ওদের জন্য দোয়া করিস !

: আচ্ছা, এক রবিবারে সবাইকে নিয়ে চলে আয় ।

: সিওর ! এবার একদিন ফর সিওর আসবো ।

যদিও অন্য সব সময়ের মত তাদের আর আসা হলো না!

এরপর অন্টারিও লেকের পানি আবারো বরফ সাদা হলো ! গ্রীষ্মর গরম তাপে লেকের পানি আবারো নীল হলো । সময় এভাবেই গড়িয়ে যায় । আজ তার " গুড ফ্রাইডে"র ছুটি । এতদিন পর আবারো তার তটিনীর জন্য মনটা যেনো ক্যামোন করে উঠলো । লাবন্য তার প্রায় দু বছরের চাপা অভিমানকে অতিক্রম করে তটিনী কে ফোন করলো । ৪/৫ টা রিং হবার পর তটিনী ফোন ধরলো ইষৎ ঘুম জড়ানো কন্ঠে । লাবন্য দু তিন বার হ্যালো বলার পরও , তটিনী ওর কন্ঠের আওয়াজ চিনতে পারল না ।কিন্তু আবারো আগের স্টাইলেই বল্লো – :আরে আমিতো আগেই চিনেছিলাম , তোর সাথে একটু ফান করছিলাম ! এরপর যথারীতি নিত্ত নৈমিত্তিক কথা বার্তা !

:তারপর সব খবর টবর কি ? সবাই ভালো আছে ? দুলাভাইয়ের শরীর এখন ক্যামোন আছে ?

:নট ব্যাড । ওই একটু আধটু  খারাপ তো লেগেই আছে ! তোর শরীর এখন ক্যামোন ? তুই তো জব করছিস , তো ক্যামোন লাগছে ?

:খারাপ না । সহকর্মী রা খুবই সহোযোগি !

: এটা খুব্ই দরকার

: তা আমি এতদিন একটা ফোন দিতে পারিনি বলে তুইও একটা ফোন দিলি না ? ক্যামোন বন্ধু তুই ?

: নারে খুবই ব্যস্ত, তার মধ্যে দিয়ে সময় অতিবাহিত হচ্ছে !

: আচ্ছা কিসের এত ব্যস্ততা ? ইতিমধ্যে কি নানি হয়ে গেলি নাকি ? :নারে ...। ওসব এখনো হই নাই । প্রশ্নও নাই ।

: ক্যানো রে ? এমন করে বলছিস ক্যানো , বিয়ে যখন হয়েছে , একদিন বেবি ও হবে ইনশাল্লাহ ,তাই না ? ওর এসব কথার কোন জবাব না দিয়ে , হঠাৎই তটিনী খুবই শীতল এবং কঠিন কন্ঠে বললো : আর কত অভিনয় করবি ,লাবন্য ? অলরেডী তুইতো জানিস যে , নিশার ডাইভোর্স হয়ে গেছে তাও দেড় বছরের উপর হয়ে গেছে ?

: কি বলছিস তটিনী এসব ? লাবন্য হঠাৎ করেই যেন ফ্রিজ হয়ে গ্যালো !ওর মাথায় যেন মনে হলো "টু ইন টাওয়ার " ভেঙ্গে পড়লো । কারন তটিনীর কাছ থেকে পাওয়া এই সংবাদ , এবং তটিনীর এই অনভিপ্রেত আক্রমনে লাবন্য যেনো বিস্ময়ে আবিষ্ট হয়ে গ্যালো ! ওর জবাব দেবার ক্ষমতাই লোপ পেলো ! তবু অনেকক্ষন পর নিজের ভেতরে যেন শক্তি সঞ্চয় করে বল্লো: তুই এসব কি বলছিস ? আমি আসলে বুঝতেই পারছি না ! আমি কসম আল্লাহ কিছুই জানি না ! বরং তোর কাছ থেকে নিশার সংবাদ শুনে আমি হতভম্ভ হয়ে পড়েছি ! তটিনী তার জবাব শুনে একটুও বিশ্বাস তো করলোই না বরং দ্বিগুন তীক্ত কন্ঠে জবাব দিলো—:দ্যাখ বেশী ঢং করিস না! এইসব ঢং আমার ভালো করেই জানা আছে।

:তটিনী, তোর মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেছে? এসব কি বলছিস তুই? তুই আমাকে কতদিন ধরে জানিস , ভুলে গেছিস ? আমি মিথ্যা কথা বলিনা তুই ভালো করেই জানিস!!

:ওসব পুরানো কথা বাদ দে , এখন ওসব থিওরী চলে না!মানুষজন এখন আমার বাসায় ফোন করে মজা নিতে !

: তার মানে আমি তোর বাসায় ফোন দিয়েছি মজা নিতে?

: তাই দেখছি তো সবাই করছে ইদানিং।,এমন কি প্রথমে সবাই ফোন করে নাটক করে ,ঘটা করে চূক চূক করে!তারপর মুল প্রসঙ্গে চলে আসে । এমনকি আমার ডাইভোর্সি কন্যার জন্য কারো ভাই,ভাগ্নে ,দেবর ইত্যাদি সব রিলেটিভদের জন্য প্রপোজালও আনছে! তোরও এইরকম কেও আছে তো ঝটপট বলে ফ্যাল!নাটক করার দরকার নাই ! আমি আজকাল আর মাইন্ড করি না!

লাবন্য কোনো জবাব দেবার সুযোগই পাচ্ছিলোনা! তটিনীর একের পর এক আক্রমনে লাবন্য একদম পর্যুদস্ত হয়ে পড়ছিল! ভেবেই পাচ্ছিলো না কিভাবে সে তটিনীকে শান্ত করবে? অথবা সে যে সত্যিই কিছু জানতো না ,এটাই বা সে 

কিভাবে বিশ্বাস করাবে ? অনেক্ষন ধরে লাবন্য ব্যর্থ চেষ্টার পর, অবশেষে ও ক্ষান্ত দিলো, অনেকটা রনে ভঙ্গ দেবার মত ! তারপর খুব শান্ত স্বরে বল্লো –

: তটিনী, তুই আসলেই কোনো কিছু শোনার মত মানসিক অবস্থায় নাই ! তোর জন্য আমার সত্যিই আজ শুধু মাত্র করুনা হচ্ছে! মায়া হচ্ছে্না! তবু দোয়া করছি আল্লাহ পাক তোকে আবার স্বাভাবিক করে দিক ! তোর কন্যাদেরও মঙ্গল হোক! এটা বলেই লাবন্য ফোনটা কেটে দিলো! যা সে কখনো করে না! লাবন্যের অপরূপ সুন্দর একটা ছুটি’র মুড যেনো ধ্বংশ হয়ে গ্যালো। কারন লাবন্য শেষপর্যন্তও  তটিনীকে বিশ্বাস করাতে পারেনি! ওর প্রচন্ড কান্না পাচ্ছিলো! প্রায় ৪০ বছর ধরে ওরা একে অপরকে চিনতো! হয়তো জানতো না! তবু একটা সুদীর্ঘ সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার কষ্টে লাবন্য বেদনায় মুহ্যমান হলো! ঘরের ভেতরে তার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো! ব্যাল্কোনিতে চলে এলো! রেলিংএর উপর হাত দিয়ে হাইওয়ের ব্যস্ততা দেখলো! তারপর লেকের জল দেখলো যেখানে অস্তমিত সূর্যের লালিম আলো এসে পড়েছে। সেখানে আলো আধাঁরের এক ছায়াচ্ছন্ন খেলা চলছে। লাবন্য দু চোখ ভরা কান্না নিয়ে তাকিয়ে রইলো অনিমেষ, রহস্য ভরা অন্টারিও লেকের দিকে !!!!!!