Table of Content

Kazi Sabbir Ahmed
NA
NA
9 articles

পীর কাহিনী

লেখক: কাজী সাব্বির আহমেদ Category: প্রবন্ধ (Essay) Edition: Dhaboman - Eid 2018

সমস্যাবিহীন জীবন মানুষ কখনোই যাপন করেনি। সভত্যার সেই ঊষা লগ্ন থেকেই সমস্যা মানুষের নিত্য সঙ্গী। কালের বিবর্তনে এই সমস্যার প্রকৃতি হয়ত বদলিয়েছে, কিন্তু মানুষের জীবন কখনোই কিংবা কোন যুগেই সমস্যা মুক্ত হয়নি। অতীত অথবা বর্তমানের মানুষ যেমন পারেনি সমস্যাকে পুরোপুরি জয় করতে, তেমনি ভবিষ্যতের মানুষও যে পারবে তার কোন সম্ভবনা এখনও কোথাও উঁকি দিয়ে দেখা দেয়নি।

মানুষের আদি সমস্যা হলো ক্ষুন্নিবৃত্তির সমস্যা। আদিম যুগে এই সমস্যার একমাত্র সমাধান ছিলো শিকার। তখনকার মানুষেরা তাদের মেধা এবং শ্রমের পুরোটাই প্রয়োগ করত এই শিকারের পিছনে। তারা লক্ষ্য করে দেখলো যে শিকারের জন্য শুধু মেধা এবং শ্রম যথেষ্ট নয় - ভাগ্যও এর সাথে জড়িত। তখন থেকেই মানুষ ভাগ্যকে জয় করার জন্য অলীক কিছুর প্রতি নতজানু হতে শিখল। যে সমস্যার সমাধান মানুষের নাগালের বাইরে, তার সমাধান আছে শুধু অলৌকিকতার মাঝে - এই প্রত্যয় ক্রমশ দৃঢ় ভাবে দানা বাঁধতে শুরু করল মানুষের মননে সেই আদিম যুগ থেকেই। কালের আবর্তনে এই প্রত্যয় কেবল দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে যার অসংখ্য প্রমাণ আমরা দেখতে পাই ইতিহাসের পাতায় পাতায়। অর্ধেক পৃথিবী জয় করা চেঙ্গিস খানকেও আমরা দেখি আকাশ দেবতার রোষানলে পড়ার শঙ্কায় শংকিত। তার সেনাপতিদের দেখি যুদ্ধে যাবার আগে যুদ্ধ দেবতার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পূজার আয়োজনে একনিষ্ঠ।

মানুষের এই গভীর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্বাসকে পূঁজি করেই সমাজে আবির্ভূত হয়েছে গুণীনদের, যাদের মূল কাজ হচ্ছে মানুষকে তার চাহিদা মতন অলৌকিকতার আশ্বাস দেয়া। পরবর্তীতে ধর্মের সাথে মিশে এই গুণীনদের নোতুন পরিচয় হয়েছে পীর, ফকির কিংবা তান্ত্রিক। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতন আমাদের দেশেও এই পীর ফকিরেরা বিস্তার লাভ করেছে সমাজের বিভিন্ন স্তরে। আমাদের সাহিত্যেও তার প্রতিফলন আমরা তা দেখতে পাই।

কবি জসীম উদ্দিনের বিখ্যাত 'বাঙ্গালীর হাসির গল্প' -এর শেষ গল্পটি হচ্ছে 'শেয়ালসা পীরের দরগা'। কিভাবে শিয়ালের বিষ্ঠার উপর চতুর রহিম শেখ পীরের দরগা স্থাপন করেছিলো সেটাই ব্যঙ্গ রসাত্মকভাবে বর্ণিত হয়েছে এই গল্পে। আবার সমাজে পীরের দরগার সুগভীর প্রভাবকে চিত্রিত করেছেন সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ্‌ তার 'লালসালু' উপন্যাসে। ভীন গ্রাম থেকে আগত মজিদ সুনিপুণ চতুরতার আশ্রয় নিয়ে রাতারাতি গড়ে তুলে 'মোদাচ্ছের' পীরের দরগা। আর এই দরগাকে পুঁজি করে ক্রমশ সে গ্রামের এক গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তিতে পরিণত হয়। ওপার বাংলার বিখ্যাত সাহিত্যিক মুস্তাফা সিরাজের 'অলীক মানুষ' উপন্যাসে উঠে এসেছে তদকালীন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার মুসলিম সমাজের চিত্র। এই উপন্যাসের প্রাণ পুরুষ বদিউজ্জামান আল খোরাসানী একজন ইমাম, যিনি তার পরিবার আর একদল অনুসারীদের নিয়ে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে ঘুরে বেড়ান উপযুক্ত পরিবেশের সন্ধানে যেখানে তিনি ফরাজী মতবাদ অনুযায়ী ইমামতি করতে পারবেন। ধর্মীয় অনুশাসন পালনে তিনি ছিলেন আপোষহীন এবং অত্যন্ত নিষ্ঠাবান। নিজে ছিলেন পীরতন্ত্রের ঘোর বিরোধী অথচ অলীকতায় বিশ্বাসী গ্রামের সাধারণ মানুষেরা তাকেই কিনা পীর হিসেবে মানতে শুরু করে। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ইমাম বদিউজ্জামান অবশ্য এক সময় গ্রামের মানুষদের এই ধারণাকে প্রশ্রয় দেয়া শুরু করেন। তার দুই সন্তানের একজন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। উপন্যাসের এক পর্যায়ে আমরা দেখি যে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী সেই সন্তানের আরোগ্য কামনায় তার স্ত্রী তার অজান্তে পরিত্যক্ত এক পীরের দরগায় মানত দেয়। এরপর যখন সেই পুত্রের মানসিক বিকাশের কিছুটা উন্নতি হয়, তখন তার স্ত্রীর মনে জায়গা করে নেন পীরের দরগার ক্ষমতা, অথচ ধর্মে তা সম্পূর্ণ বারণ। আসলে আমাদের সাহিত্যে আমাদের সমাজেরই বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে।

আমরা এমন একটি সমাজে বাস করি যেখানে পীরতন্ত্র একটি গ্রহণযোগ্য উপাদান। সমাজের স্তরভেদে এই পীরতন্ত্রের অবয়ব ভিন্ন, আবার বিশেষ বিশেষ পীর তরিকায় দেখা যায় সমাজের সকল স্তরের মানুষের অংশ গ্রহণের অবাধ সুযোগ। তবে সেক্ষেত্রে আয়োজকদের নিতে হয় বিপুল কর্মযজ্ঞের উদ্যোগ। আটরশি পীরের আখড়া হচ্ছে সেরকম এক উদ্যোগ যা এরশাদ সরকারের আমলে সারা দেশব্যাপী আলোচিত হয়। সেখানে ছিলো অসংখ্য মানুষের আনাগোনা এবং সকাল সন্ধ্যা জুড়ে ছিলো উৎসবের আমেজ। এই ভিড়ভাট্টায় ফেরারী আসামীদের ভিড়ে যাওয়াটা অসম্ভব কোন ব্যাপার না, তবে সেই আস্তানা থেকে পুলিশের পক্ষে আসামী গ্রেফতার অবশ্যই একটা অসম্ভব ব্যাপার। পরে অবশ্য আমরা আটরশি পীরের ছেলেকে অভিজাত গুলশান এলাকা থেকে গভীর রাতে বিলাসবহুল পাজেরো জীপ আর অবৈধ অস্ত্রসহ গ্রেফতার হতে দেখি। এরশাদের বহু রাজনৈতিক ডিগবাজীর মাঝে হয়ত এই গ্রেফতার নাটকও ছিলো একটি ডিগবাজী।

আটরশি পীরের মতন আরো কিছু পীর আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিলো কিংবা এখনও করে যাচ্ছে। এদের মধ্যে সর্ষিণার এবং চরমোনাইয়ের পীর অন্যতম। স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ভ্রমনে এসে বেনজির ভূট্টো সর্ষিণার পীরের সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে খবরের কাগজের শিরোনাম হয়েছিলেন। জনপ্রিয় কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ তাঁর 'জোছনা ও জননীর গল্প' উপন্যাসে বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন সর্ষিণার পীরের কীর্তি কাহিনী। তাঁর বাবা যখন নিখোঁজ, তাঁরা পুরো পরিবারসহ আশ্রয় নিয়েছিলেন এই পীরের আস্তানায়। তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন এই পীরের সাথে পাকিস্থান আর্মির যোগাযোগ। আরও অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছেন যে এই সর্ষিণার পীর মুসলমান পরিবারের পাশাপাশি হিন্দু পরিবারদেরকেও আশ্রয় দিয়েছিলেন তার আস্তানায়। তবে হুমায়ূন আহমেদ খুবই মর্মাহত হয়েছিলেন যখন এই সর্ষিণার পীরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে 'একুশের পদক' দেয়া হয়। বর্তমান কালে চলমান রাজনীতিতে সক্রিয় চরমোনাইয়ের পীর। তবে তিনি তার পীর পরিচয় দূর করার জন্য সচেষ্ট। সেই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সম্প্রতি বলেছেন - 'ক্ষমতা আল্লাহ্‌র, পীর ও দরবারের ক্ষমতায় বিশ্বাসীরা জাহান্নামী'।

আমাদের মাঝে কাউকে কাউকে আমরা দাবী করতে দেখি পীর বংশের লোক হিসেবে। এই দাবী করে তারা কী বার্তা দেন অনেক ক্ষেত্রেই তা অস্পষ্ট। বঙ্গবন্ধু হত্যার অন্যতম আসামী কর্নেল ফারুক রহমানকে ফাঁসির আগে যখন জেলখানার ইমাম তওবা পড়াতে এলেন, তখন তিনি তার কাছ থেকে তওবা পড়তে রাজী হননি। তিনি নিজেকে পীর বংশের লোক হিসেবে পরিচয় দেন। দাবী করেন যে তার বংশে অনেকেই নাকি 'জিন্দা পীর'। পাঁচজনের মধ্যে তার ফাঁসিই অবশ্য সর্বপ্রথম কার্যকর করা হয়েছিলো।

তবে আমাদের দেশে রাজনীতির সাথে সম্পর্কহীন পীরদের সংখ্যাই বেশী। আর তাদের টার্গেট গ্রুপও ভিন্ন ভিন্ন। যেমন আশির দশকে বাংলাদেশের দৈনিকগুলোতে 'সাইদাবাদী পীরের দোয়ায় সন্তানলাভ' এই শিরোনামে নিয়মিত বিজ্ঞাপন দেখা যেত। বর্তমানে অবশ্য এই পীরের আর কোন নামডাক শোনা যায় না। সন্তানহীন দম্পত্তিরাই ছিলো তার টার্গেট গ্রুপ। সম্প্রতি দেখা দিয়েছে 'হজ্ব বাবা' নামক এক পীরের যার টার্গেট গ্রুপ হচ্ছে যে সব গরীব মুসলমান যাদের হজ্ব করার মতন আর্থিক সঙ্গতি নেই। কাবা শরীফের রেপ্লিকা বানিয়ে নিজ আস্তানার আঙ্গিনাতেই হজ্ব করাচ্ছেন তিনি অল্প টাকার বিনিময়ে। ঢাকার মোহাম্মদপুরে দেখা দিয়েছিলো মানসিকভাবে অপ্রকৃতস্থ 'হাঁটা বাবা' যার কাজ ছিলো অবিরাম হাঁটা। আর তার হাঁটার সঙ্গী হতো হাজার হাজার মানুষ। সেই হাজার মানুষের হাঁটার ভিড়ে যে জল ঘোলা হতো, সেই ঘোলা জলে মৎস্য শিকার করতো 'হাঁটা বাবা'কে ঘিরে থাকা একটি চক্র।

সমাজে পীর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে যে কাজটি অবশ্যই করণীয় সেটি হলো এমন কিছু করা যাতে সাধারণ মানুষেরা 'টাসকি' খেয়ে যায়। লোকমুখে শোনা, আরিচার এক পীর সাহেবের জেয়াফত পড়েছে পাশের গ্রামে। পীর বলে কথা, তাই গ্রামবাসীরা লেগে গেলো পঞ্চাশ পদের মুখরোচক ব্যঞ্জনের আয়োজনে। পীর সাহেব জেয়াফতে এসে শুধু কাচকি মাছের ঝোল দিয়ে অল্প একটু ভাত দিতে বললেন। এত পদের মাছের আয়োজন, অথচ সামান্য কাচকি মাছের ঝোলটাই করা হয়নি। মানুষজন 'টাসকি' খেয়ে গেলো, আর পীর সাহেবের কুদরতির কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো।

সাধারণ খেঁটে খাওয়া মানুষেরা স্বপ্ন দেখে কোন এক অলীক ছোঁয়ায় পরিবর্তন হবে তাদের ভাগ্যের, ধরা দিবে সৌভাগ্য। সেই অলীক ছোঁয়ার সন্ধানে তারা মুখাপেক্ষী হয় ভাগ্য গণনাকারীদের। সমাজের স্তরভেদে এই ভাগ্য গণনাকারীদের চেহারাও ভিন্ন। রাস্তার পাশে টিয়া পাখী দিয়ে যেমন ভাগ্য গণনার ব্যবস্থা আছে, তেমনি আছে অভিজাত পাড়ায় এ সি দেয়া 'মহাজাতক'-দের চেম্বার। ফলাফল কিন্তু একই। সবাই আপনাকে এক অলৌকিকতার আশ্বাস দিয়ে কিছু সম্মানী হাতিয়ে নিবে। আবার অনেকে সম্মানীর বদলে ভাগ্য পরিবর্তনকারী পাথরের দামটাই শুধু নিবে। এতে দর্শনার্থীদের ভাগ্যের পরিবর্তন না হলেও গণনাকারীদের ভাগ্যের চাকা যে ঘুরে যায় তাতে কোন সন্দেহ নেই। ঢাকার জিপিও-র সামনে ফুটপাথে বসে এমনই এক টিয়া পাখী দিয়ে ভাগ্য 

গণনাকারীর সম্পত্তির তালিকা ছিলো দীর্ঘ - গুলশানের বাড়ী, হাল আমলের গাড়ী, ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষা সব কিছু মিলিয়ে তিনি ছিলেন সমাজের উচ্চবিত্তের অন্তর্ভূক্ত।

অনেক পীর আবার তার লেবাস আর দৈহিক আকৃতি দিয়ে মানুষজনকে 'টাসকি' লাগিয়ে দেন। তারা হয়ত 'প্রথমে দর্শনদারী তারপরেতে গুণ বিচারী' মন্ত্রে বিশ্বাসী। ঢাকার 'দেওয়ানবাগী'র পীর হচ্ছে এই ক্যাটাগরীর পীর। এই পীরের দাবী তার সাথে নাকি আল্লাহ্‌ তা'য়ালার সরাসরি কথাবার্তা হয়। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যখন দলে দলে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিচ্ছিলো, তখন আল্লাহ্‌কে নাকি বেশ চিন্তিত মনে হয়েছিলো এই পীরের।

ডিজিটাল বাংলাদেশে সম্প্রতি দেখা মিলেছে 'ডিজিটাল পীর'-এর। মিডিয়াতে তিনি পরিচিতি লাভ করেছেন 'টেরেট বাবা' নামে। প্যারা সাইকলজীর উপর একটা রিয়েলিটি শো-এর মাধ্যমে তার আগমন। 'ইউ টিউব' ভিডিও-তে তিনি 'জীন'দের কিছু কাণ্ডকারখানা দেখিয়ে একশ্রেনীর দর্শকদের 'টাসকি' লাগিয়ে দেন এবং একটি ক্লায়েন্ট বেইস গড়ে তুলেন।

আমাদের সমাজে আবার মিশে আছে বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী পীরের দরগা শরীফের নাম। আজমীর শরীফ কিংবা খাজা বাবার দরগা হচ্ছে সেই ঘরানার। ছোটবেলায় আমাদের বাসায় চিঠির ভেতর আজমীর শরীফ থেকে শুকনো গোলাপ পাঁপড়ি আর তবারক আসতো, সাথে 'মানি অর্ডার'এর ফর্ম। আমার ধারণা বাংলাদেশের অনেক মানুষেই এই চিঠি তখন পেতেন। আজমীর শরীফের মাজার বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পরিচিত একটি নাম। হুমায়ূন আহমেদ তার প্রথম চলচ্চিত্র 'আগুনের পরশমণি' মুক্তির আগে গিয়েছিলেন এই আজমীর শরীফের আশীর্বাদ নিতে।  সেখানে তিনি বিস্ময়করভাবে দেখা পান সাজিয়া আফরিনের। নূতনকুঁড়ি-র বিখ্যাত শিশুশিল্পী সাজিয়া আফরিন হঠাৎ করেই নিরুদ্দেশ হয়ে যান যখন তিনি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। লোকমুখে জানা যায় যে এই হঠাৎ নিরুদ্দেশের কারণ হচ্ছে পারিবারিক চাপে অনুষ্ঠিত আজমীর শরীফের প্রধান খাদিমের ছেলের সাথে তার বিয়ে। হুমায়ূন আহমেদ যখন তার দেখা পান তখন তার স্বামী আজমীর শরীফের প্রধান খাদিম।

চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী, খুলনার খান জাহান আলী আর সিলেটের হজরত শাহ্‌ জালালের মাজার যুগ যুগ ধরে জনপ্রিয় হয়ে রয়েছে আমাদের সমাজে। আমরা এই শহরগুলোতে বেড়াতে গেলে এই মাজারগুলিতে একবার হলেও ঢুঁ মারার চেষ্টা করি। অবশ্য এই ঢুঁ মারার পিছনে বায়েজিদ বোস্তামীর মাজারের কচ্ছপ, খান জাহান আলীর মাজারের কুমীর আর হজরত শাহ্‌ জালালের মাজারের জালালী কবুতর দেখাটাও অবশ্য একটা মূখ্য বিষয়।

সম্প্রতি আমাদের দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের নামকরণ করা হয়েছে হজরত শাহ্‌ জালালের নামানুসারে। এই নামকরণ অবশ্য অনেকের কাছেই এক ধরণের রাজনৈতিক প্রতিশোধ হিসেবে বিবেচিত। কারণ এই বিমান বন্দরটির পূর্ববর্তী নামটির সাথে জড়িয়ে ছিলো এক জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের নাম। সেই নাম যাতে পরবর্তীতে আর না আসতে পারে সেই কারণে এই নামকরণ। কারণ একজন আউলিয়ার নাম বদলানোর সাহস কোন রাজনৈতিক দলের সহসা হবে না।

শুধু ইসলাম ধর্মে কিংবা আমাদের সমাজেই নয়, এই পীর প্রীতি কিন্তু অন্য ধর্মে কিংবা অন্য সমাজে বিশেষ করে পশ্চিমা সমাজেও ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। ইংল্যান্ড ভিত্তিক খৃস্টান ধর্মের থিঙ্ক ট্যাংক 'থিও'-এর রিপোর্টে জানা যায় যে, 'এক্সরসিজম' কিংবা খৃষ্টীয় কায়দায় জীন-ভূত তাড়ানোর বিদ্যা অর্জনের চাহিদার হার বেড়ে গেছে অনেক গুন। কারণ হিসেবে জানিয়েছে যে ইউরোপীয় সমাজে আজ অনেক মানুষই মনে করে যে তারা অশুভ আত্মার দ্বারা আক্রান্ত। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ধর্মীয় গুরুদের কাহিনী এখানে উল্লেখ না করে বরং তারা কিভাবে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে প্রভাব বিস্তার করেছে সেই প্রসঙ্গে সামান্য আলোকপাত করা যেতে পারে।

বঙ্গ-সন্তান নরেন্দ্র নাথ দত্ত ওরফে স্বামী বিবেকান্দ ১৮৬৩ সালে মহিসুরের রাজার আর্থিক আনুকূল্যে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সুদূর আমেরিকাতে আসেন 'ওয়ার্ল্ড'স পার্লামেন্ট অব রিলিজিয়ন' নামক সভাতে যোগ দিতে। হিন্দু ধর্মমতে সমুদ্র পাড়ি দেয়া ছিলো সেই যুগে নিষিদ্ধ। কিন্তু স্বয়ং শ্রী রামকৃষ্ণ স্বপ্নে এসে নরেন্দ্র নাথকে সমুদ্র পাড়ি দিতে বলে, ফলে সেই বাঁধা আর বাঁধা রইল না। বলা হয়ে থাকে তিনিই প্রথম ব্যক্তি হিন্দু ধর্মকে যিনি উত্তর গোলার্ধের মানুষের কাছে তুলে ধরেন। পরবর্তীতে এই 'ওঁম শান্তি'র পথ ধরে পাড়ি জমান অনেকেই তাদের মধ্যে ভগবান রজণীশের নাম বিশেষ গুরুত্ব রাখে। আজকে উত্তর গোলার্ধে 'বিক্রম ইয়গা'র যে তুমুল জনপ্রিয়তা তার পিছনেও কিন্তু অবদান রয়েছে নরেন্দ্র নাথ দত্তের সেই ঐতিহাসিক ভ্রমণের।

বন্ধুস্থানীয় এক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর মতে দেশে দেশে যুগে যুগে এই পীরতন্ত্র হচ্ছে একটি বাণিজ্যিক উদ্যোগ। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে কিভাবে একজন নতুন পীরের জন্ম দেয়া যায় অর্থাৎ নতুন একটি ভেঞ্চার খোলা যায় সেই বিষয়ে তার অভিমত জানিয়ে আজকের লিখাটির ইতি টানব।

পীরতন্ত্রের মূলে রয়েছে স্টান্টবাজী। তাই এই প্রজেক্টের প্রতিটি ধাপে থাকতে হবে এই উপাদান। প্রথমে নির্বাচন করতে হবে একজন পীর যাকে লোকচক্ষুর অন্তরালে অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে রাখতে হবে কয়েক মাস। এতে তার গাত্রবর্ণে এক ধরণের উজ্জ্বলতা আসবে, তাতে সাধারণ মানুষেরা 'টাসকি' খাবে তার নূরানী চেহারা দেখে। এই কয়েক মাসের অন্তরীণ জীবনে তাকে কণ্ঠস্থ করতে হবে কোরান শরিফের বেশ কিছু আয়াত যা সাধারণত নামাজের সময় পড়া হয় না। অর্থাৎ পীর যখন আরবীতে অনর্গল কোরানের আয়াত বলে যাবে, সাধারণ মানুষেরা সেখানেও 'চমক' দেখবে। এই নতুন পীরের যাত্রা শুরু হবে 'পবিত্র ওরস মোবারক' দিয়ে। কোরবানী ঈদের আগে আগে এই ওরস মোবারকের আয়োজন করতে হবে। কোরবানির হাটের উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গরু ছাগলের যে যাত্রা শুরু হয়, সেই যাত্রার সামনে লাল কাপড়ে 'পবিত্র ওরস মোবারক' লেখা ব্যানার নিয়ে মানুষদের টানতে হবে মিছিলে। সাধারণ মানুষেরা ভাববে সঙ্গের সব গরু ছাগলেরা বুঝি ব্যবহৃত হবে ওরসের খানায়। দল ভারী হবে তাতে। মিছিল যখন ওরসের ময়দানে এসে জমায়েত হবে, পথের পরিশ্রমে সবাই হবে ক্লান্ত, সারা শরীরে হবে ব্যথা বেদনা, অনেকেরই হবে পেটের পীড়া। ফ্লাজিল আর প্যারাসিটামল মিশানো পানি পীরের পড়া-পানি হিসেবে দেয়া হবে সবাইকে। হাতে নাতে ফল পেয়ে সাধারণ মানুষেরা আবারও 'টাসকি' খাবে। তারপর পীর যখন মঞ্চে উঠবেন তার নূরানী চেহারা তো আছেই মানুষদের চমকে দেয়ার জন্য। অর্থাৎ চমকের পর চমক। আমার সেই বন্ধুর দৃঢ় বিশ্বাস ঠিক মতন প্রজেক্ট প্রপোজাল লিখে জমা দিলে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ পাওয়া সম্ভব, কারণ পীর ব্যবসা হচ্ছে একটি পরীক্ষিত লাভজনক ব্যবসা।

কিন্তু ইসলাম পীর আউলিয়ার উপর বিশ্বাস স্থাপন করাকে 'শিরক' বলে বিবেচনা করে যা হচ্ছে সবচেয়ে বড় গুনাহ। নবী মুহাম্মদও (সাঃ) যে একজন সাধারণ মানুষ সে কথা আল্লাহ্‌ কোরান শরীফে উল্লেখ করেছেন এই ভাবে - "বলুনঃ আমিও তোমাদের মতই একজন মানুষ, আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের প্রভূই একমাত্র প্রভূ। অতএব, যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎ কর্ম সম্পাদন করে এবং তার পালনকর্তার এবাদতে কাউকে শরীক না করে" (১৮:১১০)।