পবিত্র ক্বাবা শরীফ এবং বিলবোর্ডে ডোমিনো পিজা

লেখক: কাজী সাব্বির আহমেদ Category: প্রবন্ধ (Essay) Edition: Dhaboman - Winter 2020

ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ হজ্জ, যা কিনা শারীরিক এবং আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান সকল মুসলিম নরনারীর জন্য ফরয। বিশ্বব্যাপী কোভিডের প্রকোপ প্যান্ডেমিকের আকার ধারণ করার কারণে গত বছর খুবই সীমিত আকারে পবিত্র হজ্জ পালিত হয়েছে। সৌদি আরবে অবস্থানরত প্রায় শ'খানেক বাছাইকৃত হাজীদের দ্বারা এই হজ্জ পালিত হয়। এক সময় আশঙ্কা করা হয়েছিল যে হয়ত ২০২০ সালে হজ্জ অনুষ্ঠিত হবে না। ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে অতীতেও বেশ কয়েকবার হজ্জ পালন বন্ধ হয়েছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণে। আবার হাদিসের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে আমরা এটাও জানি যে, শেষ জমানায় হজ্জ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে কোভিডের কারণে এইবার  যখন হজ্জ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল, বিশ্বের সকল মুসলমানদের ভেতর তখন এক ধরণের আতঙ্কের হাতছানি দিয়েছিল এই ভেবে যে তবে কি আমরা শেষ জমানার খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। যদিও এবার হজ্জ বন্ধ হয়নি, তবে শীঘ্রই যে আবার স্বাভাবিক কলেবরে তা চালু হচ্ছে না তা কিন্তু সহজেই অনুমেয়। কারণ এখনও পর্যন্ত কোন কার্যকরী টীকা বাজারে আসেনি অথবা আসলেও সেই টীকা যে কতখানি কার্যকরী হবে এই মুহূর্তে সেই সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণা নেই। তাই যারা এ বছর হজ্জে যাওয়ার জন্য নিয়ত করেছিলেন তারা এখন অনেকটাই অনিশ্চিত কবে নাগাদ তারা হজ্জ পালন করতে সক্ষম হবেন। কিংবা সেই হজ্জ পালনের সুযোগ যখন আবার আসবে তখন আদৌ কি তারা হজ্জ পালনের সামর্থ্য বজায় রাখতে পারবেন কিনা।

প্যান্ডেমিকের ঠিক দুই বছর আগে অর্থাৎ ২০১৮ সালে আমি পবিত্র হজ্জব্রত পালন করি। অল্প কিছুকাল আগ পর্যন্তও আমাদের উপমহাদেশের মুসলমানদের মনোভাব এই ছিল যে সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব পালন শেষে হজ্জের উদ্দেশ্যে যাত্রা করাটাই বাঞ্ছনীয়। ফলে যখন হজ্জের জন্য তারা তৈরি হতেন তখন তারা ইতিমধ্যে বার্ধ্যকে উপনীত হতেন। অথচ ইন্দোনেশিয়া কিংবা মালেয়শিয়ার মুসলমানরা অনেকেই বিবাহের পূর্বেই হজ্জ পালনে উদগ্রীব থাকেন। অনেক স্কলারদের মতে শারীরিক এবং আর্থিক সামর্থ্য অর্জনের পরপরই হজ্জ পালন করা উত্তম, কারণ আমরা যদি মনে করি সামনে তো আরও সময় আছে, তবে হয়ত আমরা একদিন এই সামর্থ্যগুলি হারিয়েও ফেলতে পারি। তার চাইতেও বড় কথা আমরা আর কতদিন বেঁচে থাকব তা কিন্তু জানি না। আমি নিজেও কিন্তু আমাদের এই উপমহাদেশীয় ধারণার বাইরে ছিলাম না। কিন্তু বয়স যখন পঞ্চাশ পূর্ণ হলো তখন আমি আমার মেজো ভাইয়ের উপদেশে হজ্জে যাওয়ার ব্যাপারে সিরিয়াস হয়ে উঠি এবং কাল বিলম্ব না করে সেই বছরেই হজ্জে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। আমি মনে করি সেই সিদ্ধান্তটি ছিলো আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম সিদ্ধান্ত। তখন যদি হজ্জে যাওয়ার সিদ্ধান্ত না নিতাম, তবে হয়ত প্যান্ডেমিকের নিষেধাজ্ঞার ফলে আমার হজ্জ-যাত্রাও অনিশ্চিত হয়ে পড়ত, অথচ আমার উপর হজ্জ ফরয হয়ে আছে অনেক আগে থেকেই। ধরতে গেলে সেই পঁচিশ বছর আগেই যখন আমি আমার ক্যারিয়ার শুরু করেছিলাম। আমি নিজেকে মহান আল্লাহ্‌ তা'য়ালার বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্ত বলে মনে করে থাকি কারণ তিনি প্যান্ডেমিকের পূর্বেই আমাকে হজ্জ করার তওফিক দিয়েছেন। হজ্জ পালন নাকি সবার ভাগ্যে থাকে না। ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে অতীতের অনেক ক্ষমতাবান এবং সামর্থ্যবান রাজা-বাদশাহরা হজ্জ পালন করে যেতে পারেননি। তাই বলা হয়ে থাকে যে হজ্জ কেবলমাত্র তারাই পালন করতে পারবেন যাদেরকে আল্লাহ্‌ তা'য়ালা তার ঘরে মেহমান হিসেবে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসেন। তাই এই দাওয়াতপ্রাপ্ত সকল হাজীগণ নিজেদেরকে আল্লাহ্‌র বিশেষ রহমতপ্রাপ্ত হিসেবে ভাবতেই পারেন।

আগে মনে করতাম হজ্জে যাওয়ার বন্দোবস্ত করাটা এক বিরাট ঝক্কি ঝামেলার ব্যাপার। কিন্তু বাস্তবে যখন হজ্জে যাওয়ার জন্য মনস্থির করলাম তখন দেখলাম আসলে কঠিন কিছুই নয়। শুভাকাঙ্ক্ষী এক ছোটভাইয়ের পরামর্শে টরন্টোস্থ আল-মাদীনা গ্রুপের অফিসে গিয়ে ম্যানেজার ফায়েজ ইয়াহিয়ার সাথে দেখা করি। তিনি আমাকে তার সামনে বসিয়ে রেখে কম্পিউটারে আমার নাম-ধাম, পিতা-মাতার নাম-ধাম জাতীয় ব্যক্তিগত কিছু ডেটা নিলেন। তারপর একটা প্রিন্ট আউট আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন 'অল সেট'। আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে এত সহজেই সবকিছু 'অল সেট' হয়ে যাবে। আসলে হজ্জে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মনস্থির অর্থাৎ নিয়ত করা। একবার নিয়ত পাকা করে নেমে গেলেই দেখা যাবে যে বাকী সব ফর্মালিটিজগুলো আল্লাহ্‌র রহমতে সহজ হয়ে গেছে। এই ফর্মালিটিজগুলোর ভেতর রয়েছে - এক, একটা মেডিক্যাল চেক-আপ করিয়ে সেটার রিপোর্টসহ হজ্জ এজেন্সীর মাধ্যমে সৌদী ভিসার জন্য পাসপোর্ট জমা দেয়া। দুই, সময়মতো ধাপে ধাপে হজ্জ এজেন্সীর ফি জমা দেয়া এবং তিন, তাদের আয়োজিত সেমিনারগুলিতে অংশ নেয়া। ব্যস, আপনার হজ্জ যাত্রার প্রস্তুতি শেষ, এখন যাত্রার পালা। এই ফর্মালিটিজগুলি শেষ করে আমার হজ্জ যাত্রার দিনক্ষণও ঠিক হলো এক সময়। অগাস্টের ৯ তারিখ বুধবার, বিকেল চারটায় এয়ার কানাডার বিমান যোগে টরন্টোর পিয়ারসন্স এয়ারপোর্ট থেকে কোপেনহেগেন। কোপেনহেগেনের ঘণ্টা দু'য়েকের যাত্রাবিরতির পর টার্কিশ এয়ারলাইন্স করে ইস্তানবুল। ইস্তানবুলে সাইট-সিয়িং এবং রাত্রিযাপন শেষে সৌদীয়া এয়ারলাইন্স করে মদীনা। হজ্জ যাত্রার এই দীর্ঘ আইটেনারি হাতে পেয়ে আমি বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়লাম নতুন দেশ তুরস্ক দেখার সুযোগে, তাই দেরী না করে আমার হজ্জ এজেন্সী আল-মাদীনার পরামর্শে টার্কির জন্য ই-ভিসার অ্যাপ্লাই করে ফেললাম অনলাইনে। আর হজ্জ যাত্রার আগ পর্যন্ত টরন্টোতে অবস্থিত বিভিন্ন বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় নিমন্ত্রিত হয়ে হাজিরা দিতে লাগলাম। এছাড়া নিজে থেকে পরিচিত সবার কাছ থেকে দোয়া এবং আমার পূর্বের সমস্ত দোষ ত্রুটির জন্য মাফ চেয়ে নিলাম। আর প্রত্যেকেই খুশীমনে আমাকে 'হজ্জে মাবরুর' বলে শুভ কামনা জানিয়েছিলেন। এ সময় লক্ষ্য করলাম যে অনেকেই আমাকে আলাদা করে তাদের জন্য ক্বাবা শরীফে গিয়ে দোয়া করার কথা বলছেন, বিশেষ করে তাদের বিশেষ কোন সমস্যার জন্য। অভিজ্ঞ একজনের পরামর্শে আমি আবার তাদের নামধাম এবং কি বিষয়ের জন্য দোয়া করতে হবে তার একটা নোট রাখলাম যাতে মক্কাতে গিয়ে সেই নোট ধরে দোয়া করতে পারি। এভাবেই আমার হজ্জে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে নিতে এগিয়ে আসতে লাগলো যাত্রার দিন। যেহেতু সাপ্তাহিক কার্যদিবসের দুপুরবেলাতে আমাকে এয়ারপোর্ট যেতে হবে তাই সহজে কারো কাছ থেকে রাইড পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ সবাই নিজ নিজ কাজ কিংবা ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। এই সময়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে আমাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছিয়ে দেয়ার জন্য এগিয়ে এলো আমার ক্যাডেট কলজের এক ব্যাচ জুনিয়র এক ছোটভাই। যাত্রার নির্ধারিত দিনে সে তার শত ব্যস্ততার মাঝেও সময় মতন আমাকে টরন্টোর পিয়ারসন্স এয়ারপোর্টের ডিপার্টচার লাউঞ্চে পৌঁছে দিল। ফলে আমি নির্বিঘ্নে চেক-ইন করে, ইমিগ্রেশন পার হয়ে এয়ার কানাডার ফ্লাইট ধরে অন্যান্য হজ্জ সংগীদের সাথে যাত্রা করলাম কোপেনহেগেনের উদ্দেশ্যে এবং আইটেনারী অনুযায়ী যথা সময়ে মদীনাতে এসে পৌঁছলাম। মদীনা এয়ারপোর্টে নেমেই বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারলাম যে এখানে ইংরেজী অচল, অর্থাৎ আমাকে এদের সাথে ভাব বিনিময় করতে হবে ইশারায়। অবশ্য আমাদেরকে এ ব্যাপারে আগে থেকেই জানানো হয়েছিল যে মক্কা মদীনাতে আমাদের ভাষা নিয়ে অসুবিধা হবে যা আমাদেরকে মেনে নিতে হবে।

মদীনা এয়ারপোর্ট থেকে বেড়িয়েই যার সাথে প্রথম পরিচয় হলো, সে হলো সেই বিখ্যাত লু'হাওয়া যার কথা সেই ছোটবেলা থেকেই শুনেছিলাম। সৌদী আরবের মাটিতে পা না রাখলে পৃথিবী নামক এই গ্রহ যে এত উত্তপ্ত এবং এর মাটি যে এত রুক্ষ হতে পারে সেটা কখনই জানতে পারতাম না। যাই হোক তাড়াহুড়া করে আমাদের জন্য অপেক্ষামান শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে গিয়ে উঠলাম। এক সময় বাস চলা শুরু করল। এয়ারপোর্ট এলাকা পার হতেই চোখে পড়ল বিশাল বিরানভূমি। কিন্তু সেই বিশাল বিরানভূমিতে দেখতে পেলাম মাইলের পর মাইল বিস্তৃত এলাকাকে দেয়াল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। আর কিছুদূর পর পর সেই দেয়ালের গায়ে রয়েছে রং করা বিশাল বিশাল ব্যানার। সেই ব্যানারে লেখা, 'নলেজ ইকোনমিক সিটি'। বুঝতে পারলাম ক্রাউন-প্রিন্স মোহাম্মদ-বিন-সালমান তেল ভিত্তিক অর্থনীতি থেকে সৌদি আরবকে বের করে আনার যে মহা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন, এই এলাকাটি সেই পরিকল্পনার বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হবে। আমি কোথায় যেন মালেয়শিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ-এর 'ভিশন ২০২০'-এর সাথে এর মিল খুঁজে পেলাম। নব্বই-এর দশকে মাহাথির মালেয়শিয়ার অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে 'ইনফরমেশন টেকনলজী' ভিত্তিক 'মাল্টিমিডিয়া সুপার করিডোর' প্রজেক্ট চালু করেছিলেন। আজকের আধুনিক মালেয়শিয়ার পিছনে সেই 'ভিশন ২০২০'-এর ভূমিকা যে অনস্বীকার্য সেটা আজ ২০২০ সালে এসে বেশ অনুধাবন করা যায়।  

প্রায় ঘণ্টা দু'য়েক পর আমরা মসজিদে নববীতে এসে পৌঁছালাম। দূর থেকেই মসজিদে নববী নজরে আসার সাথে সাথে পথের ক্লান্তি এবং উত্তেজনা যেন মুহূর্তেই উবে গিয়ে মনটা এক বিশেষ ধরণের প্রশান্তিতে ভরে গেল যার অনুভূতি আগে কখনই অনুভব করিনি। মদীনাতে আমরা যে পাঁচতারা হোটেলে ছিলাম সেটা ছিল মসজিদে নববীতে ঢোকার পাঁচ নম্বর গেইট থেকে দুই-তিন মিনিটের হাঁটাপথ। আবার এই গেইট থেকে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর রওযা মোবারকে ঢোকার দরজা সবচেয়ে কাছে। ফলে প্রায় প্রতিবার মসজিদে নববীতে ঢোকার পথে আমাদের প্রিয় নবীর রওযা মোবারকে সালাম দিয়ে ঢোকার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। মদীনাতে চারদিন থাকার পর আমরা 'হজ্জে তামাত্তু' করার উদ্দেশ্যে ইহরামের কাপড় পরিধান করে মক্কার উদ্দেশ্যে বাসে চেপে রওনা দিলাম। হজ্জে তামাত্তু-এর বিশেষত্ব হচ্ছে মক্কাতে পৌঁছে তাওয়াফ সম্পন্ন করার পর চুল কেটে ইহরাম থেকে বের হতে পারব, অর্থাৎ ইহরাম কালীন নিষেধাজ্ঞা আর প্রযোজ্য থাকবে না। মীনাতে যাওয়ার সময় আবার নতুন করে ইহরাম করতে হবে। কিন্তু 'হজ্জে কিরান'-এর বিধি অনুসারে মক্কাতে ঢোকার সময় যে ইহরাম বাঁধা হয় তা একবারে হজ্জ সম্পন্ন করা পর্যন্ত ধরে রাখতে হয়। অর্থাৎ শুধু ইহরামের সেলাই বিহীন পোশাকই নয়, একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ইহরামের অন্যান্য শর্তাবলী মেনে চলতে হয়। তবে এখানে উল্লেখ্য যে আমাদের নবীজি (সাঃ) মক্কা বিজয়ের পর তাঁর জীবনে একটি মাত্র বার হজ্জ পালন করেছিলেন যাকে আমরা 'বিদায় হজ্জ' নামে উল্লেখ করি। সেই বিদায় হজ্জ তিনি 'হজ্জে তামাত্তু'-এর নিয়মবিধি অনুসরণ করেছিলেন। তবে ভবিষ্যতে 'হজ্জে কিরান' পদ্ধতিতে হজ্জ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন।

বাসে মদীনা থেকে মক্কার দূরত্ব চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার, কিন্তু রাস্তায় অসম্ভব ভীড় থাকার কারণে প্রায় সাত ঘণ্টা পরে আমরা যখন মক্কায় এসে পৌঁছালাম তখন রাত্রি দশটারও বেশী বাজে। আমাদের জন্য নির্ধারিত ক্লক টাওয়ারের ভেতর অবস্থিত সুইসোটেল হোটেলের কক্ষে কোন রকমে সুটকেস রেখে, ডাইনিং-য়ে গিয়ে তাড়াহুড়া করে ডিনার সেরে আমরা ক্লক টাওয়ারের লবিতে একত্রিত হলাম। তারপর সবাই মিলে রওনা দিলাম তাওয়াফ করার উদ্দেশ্যে। তখনই প্রথমে নজরে এলো পবিত্র ক্বাবা শরীফ যা কিনা দুনিয়ার বুকে বাইতুল মামুরের আকৃতিতে তৈরি আল্লাহ্‌র ঘর। সেই ঘরের মেহমান হিসেবে আমরা উপস্থিত। 'লাব্বাইক আল্লাহ্‌হুম্মা লাব্বাইক' অর্থাৎ 'আমি হাজির, হে আল্লাহ্‌ আমি হাজির' তালবিয়ার এই ধ্বনিতে চারিদিক তখন মুখরিত। আমার কাছে মনে হচ্ছিল আমি যেন এক অপার্থিব জগতে চলে এসেছি। ছোটবেলা থেকে যে ক্বাবা শরীফের কথা শুনে এসেছি, সেই ক্বাবা শরীফ এই মুহূর্তে ঠিক আমার চোখের সামনে। ক্বাবা শরীফকে প্রথম দেখার সেই অনুভূতির কথা লিখে প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই। যাদের এই অভিজ্ঞতা অর্জনের সৌভাগ্য হয়েছে তারাই কেবল অনুধাবন করতে পারবেন আমার তখনকার সেই অনুভূতিকে।

আমরা যখন তাওয়াফ শুরু করলাম তখন প্রচন্ড ভীড়। সেই ভীড়ের মাঝে তাওয়াফ করতে করতে এক সময় একদম ক্বাবা শরীফের কাছে চলে এলাম। এক পর্যায়ে ক্বাবা সংলগ্ন হাতিমের ভেতর ঢুকে গেলাম। সেখানে নাকি দোয়া করলে সেই দোয়া কবুল হয়ে থাকে। তাই সেখানে একে একে সবার জন্য দোয়া করলাম। যারা আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, তাদের জন্য দোয়াও করলাম এখানে। তবে হাতিমে ঢুকে ক্বাবা ঘরের দেয়াল স্পর্শ করে দেখার যে অনুভূতি তা অবশ্যই সারা জীবন মনে রাখার মতন একটি অনুভূতি।

আমাদের হোটেল ক্বাবা শরীফের খুব কাছে হওয়াতে প্রতিদিনই চলে আসতাম এখানে ওয়াক্তের নামাযসহ নফল নামায আদায়ের জন্য। আর সেই সাথে তাওয়াফ। আমার সংগী জাকির ভাই ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার উমরাহ্‌ পালনের জন্য মক্কা-মদীনাতে এসেছেন। তাই ক্বাবা শরীফের বিভিন্ন গেইটসহ এর আশেপাশের জায়গাগুলির অবস্থান তার একদম নখদর্পণে। ফলে তার সাথে গিয়ে এত ভীড়ের মাঝেও ক্বাবা শরীফের ভেতর নামাযের জন্য জায়গা পেতে তেমন কোন বেগ পেতে হত না। আমরা প্রতিদিন আসরের সময় ক্বাবা শরীফে এসে নামায শেষে তাওয়াফ করতাম মাগরিবের আগ পর্যন্ত। তারপর মাগরিবের পর হোটেলে যেতাম ডিনারের জন্য। ডিনার শেষে এশার নামায আবার ক্বাবা শরীফে এসে পড়তাম। এশার পর কখনো তাওয়াফ, কখনো নফল ইবাদত সেরে হোটেলে ফিরতাম কিছুক্ষণ ঘুমানোর জন্য। ফজরের কিছু আগে আবার এসে উপস্থিত হতাম ক্বাবা শরীফে তাহাজ্জুদ আর ফজরের নামাযের জন্য। ফজর শেষে হোটেলে ফিরতাম সকালের ব্রেকফাস্ট সারার জন্য। বেশী করে ব্রেকফাস্ট করার কারণে দুপুরে আমাদের আর কিছু খেতে হতো না। অর্থাৎ আমাদের নিজেদেরকে কিছু কিনে খেতে হতো না ক্বাবা শরীফের চত্বরে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন ফাস্টফুডের দোকান থেকে। এশার নামাযের পর হোটেলে ফেরার পথে এই সব ফাস্টফুডের দোকানে বেশ ভীড় লক্ষ্য করতাম। প্রাশ্চাত্যের কেএফসি-এর আদলে 'আল বাইক' ব্র্যান্ডের এক ফ্রাইড চিকেনের ফ্রেঞ্চাইচ দোকানগুলিতে দেখতাম উপচে পড়া ভীড়। আমাকে এক বাংলাদেশী হুজুর যিনি প্রায়শই কোন এক হজ্জ এজেন্সীর 'আমীর' হয়ে হজ্জে আসেন, ঠাট্টাচ্ছলে বলেছিলেন যে, মক্কাতে 'আল-বাইক' আসার পর নাকি 'লাব্বাইক'-এর ধ্বনি কমে গেছে। যাই হোক প্রাশ্চাত্যের অন্যান্য ফ্রেঞ্চাইচ খাবারের দোকানেরও কমতি নেই মক্কা মদিনাতে।  

 
একদিন এশার পর ক্বাবা শরীফ থেকে হোটেলে ফেরার পথে চোখে পড়ল বিশাল বিলবোর্ডে জুড়ে ডোমিনো পিজার বিজ্ঞাপন। এই বিজ্ঞাপন চোখ পড়তেই আমার মনে পড়ে গেল এক ব্যাচ জুনিয়র সেই ছেলেটার কথা যে আমাকে হজ্জে আসার সময় বাসা থেকে এয়ারপোর্টে আসার রাইড দিয়েছিল। কিছুটা লাজুক কিন্তু অন্যের বিপদে নীরবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে সদা তৎপর এই ছেলেটির মালিকানায় টরন্টো শহরে রয়েছে পাঁচটি ডোমিনো পিজার স্টোর। আমার কেন যেন মনে হলো বিলবোর্ডে ডোমিনো পিজার এই বিজ্ঞাপন আমার চোখে পড়ার পেছনে নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। তাই সংগে সংগে আল্লাহ্‌র ঘরে গিয়ে তার শুভ কামনা করে দোয়া করলাম।