প্রত্যুষে প্রণয়

লেখক: মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা Category: ছোট গল্প (Short Story) Edition: Dhaboman - Winter 2020

 

ছুটির দিন, সাজাদ সাহেব দূরে দৃষ্টি মেলে বারান্দায় বসে আছেন, বৃষ্টি ঝরছে অঝোরে। সবে হেমন্তের কার্তিক শুরু হয়েছে, বৃষ্টির সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই, কিন্তু হাবভাবে মনে হচ্ছে বর্ষার শ্রাবণ ফিরে এসেছে। আর কয়েকদিন পরই দূর্গাপূজার বিজয়াদশমী। এটা অনেকটা নিশ্চিত ব্যাপার যে, পূজার আগে বৃষ্টি হবে। বৃষ্টি যেন নিছক ‍নির্মল জল নয়, এক প্রভাবক রস; যার মাদকতা প্রায় সবাইকে এলোমেলো করে। এমন বৃষ্টির মধ্যে কখন যে তিনি কৈশোরে ফিরে গেছেন নিজেও জানেন না। সাজাদ পাড়ায় তার বয়সীদের মধ্যে সবচেয়ে উচ্ছল-প্রাণবন্ত ছেলে; বেশ মেধাবী, সপ্রতিভ এবং সুদর্শনও বটে। কিন্তু প্রথাগত বিচারে তাকে খুব ভালো ছাত্র বলা যায় না। কারণ মেধার প্রতিফলন পাওয়া যায় না তার রেজাল্ট-সিটে। লেখাপড়ায় খুব অমনোযোগী ও উড়নচণ্ডি স্বভাবের কারণে। সামনে তার এস এস সি পরীক্ষা। কিন্তু সে যে রেজাল্ট ভালো করবেই সে ভরসা কেউই করে না। টেস্ট পরীক্ষা শেষ হলে তার কয়েকদিন পর বাবা তাকে ডেকে বলে, ‘স্কুলের শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ার পাশাপাশি রাজুর কাছেও নিয়মিত যাও। রাজু একজন গৃহশিক্ষক, কোনো প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করে না। দ্বিতীয় শ্রেণীতে বি.এস-সি পাশ করে চাকরির অন্বেষায় আছে। দারিদ্র্যের কারণে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া হয়নি। তবে ছাত্র হিসাবে সে বেশ মেধাবী। সব বিষয়েই ভালো।

যথারীতি রাজু মাস্টারের কাছে সাজাদের পড়তে যাওয়া শুরু হয়, এবং চলছিল স্বভাবসুলভ চালেই। একদিন যায় তো আরেক দিন যায় না। রাজু স্যার যেহেতু অনেক দিন ধরেই পড়ায়, তাই সাজাদের স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে ভালো করেই তার জানা। সাজাদদের বাড়ি থেকে রাজু স্যারের বাড়ি বেশি দূরে নয়, মাঝে একটা পাড়া। সে পাড়ার মধ্যে দিয়ে পায়ে হেঁটেই যাওয়া যায়। সাধারণত সকালেই পড়তে যায়, মাঝে মাঝে বিকেলেও যায়। এমনি একদিন বিকেলে যাচ্ছে পড়তে, যাওয়ার রাস্তায় একটা চেনা বাড়ির সামনে হঠাৎ চোখ আটকে গেলো একটা নির্জলা সুন্দর মেয়ে ওপর। সে বাড়ির গৃহকর্তা ও তার কয়েকজন ছেলেকে তার চেনা। পাশে আরেকটা মেয়ে, সে অত সুন্দর না। সুন্দর বলতে মা-বোনদের কাছ থেকে শুনে যা বুঝেছে, তা হলো ফরসা স্বাস্থ্যবতী মানেই সুন্দর। তবে মেয়েটা মোটেই স্বাস্থ্যবতী ছিল না। গড়নে পাতলা ছিপছিপে, বেশ লম্বা। চোখ দুটো কাজলকাল, লম্বা টানা টানা। গাত্র বর্ণ উজ্জল গৌর । মুখে মিটমিটে হাসি লাগা। বয়সে সাজাদের দু-তিন বছরের ছোট হবে। মেয়েটাকে সে আগেও দেখেছে, এভাবে কোনো দিন চোখে পড়েনি বা এমন অনুভূতিও কখনো হয়নি। সেদিন দেখামাত্র বুকের মধ্যে একটা ধাক্কা খায়। কেমন যেন অজানা, অদ্ভূত একটা অনুভূতি হয়। সেটা ঠিক কেমন তা যেন বোধগম্য হয় না। তবে কোনো মেয়েকে দেখে এমন অনুভূতি এর আগে কখনো তার হয়নি। সেদিন আর পড়ায় মন বসে না। পরের দিনও দেখা হবে বলে মনে হয়ে ছিল, কিস্তু হলো না। সারাদিনটা তার কেমন নিরাসক্ত ভাবে চলে গেল। পরের দিন মেয়েটার দেখা পাওয়ার প্রত্যাশা জাগলো। পরের কয়েক দিনে সেটা আকাঙ্ক্ষায় পরিণত হলো। এভাবে দিন যায় আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়। কোনো দিন এক ঝলক দেখা পায় কোনো দিন দেখা পায় না। মেয়েটার মুখে লেগে থাকা সদা মিটমিটে হাসিতে যেন রহস্য খেলে, আর চোখ যেন সে কথা বলে। সাজাদের কথা বলতে ভীষণ ইচ্ছে করে। দেখা হলে সারাদিন সে ফুরফুরে থাকে, দেখা না হলে মন মরা। একদিন রাজু স্যার বিস্ময় প্রকাশ করে বলে, ’কী রে তোর কী হলো, বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না; তোর এ পরিবর্তন তো অবিশ্বাস্য! আগে শত বলেও তোকে নিয়মিত করা যায়নি, এখন তো ঠেকানো যাচ্ছে না, আমার ঘুম হারাম করে দিয়েছিস!’

রাজু স্যার এখনো বোঝেনি, এখন পড়তে আসাটা সাজাদের কাছে গৌণ বিষয়, মূখ্য বিষয় মেয়েটার দেখা পাওয়া। পারলে দিনে কয়েক বার পড়তে আসে। এভাবে একদিন মেয়েটার সাথে তার কথাও হয়ে যায়। নাম তার নেহালি। কথা বলে বুঝতে পারে মেয়েরা যেমন কথায় চটপটে হয় সে সেরকম নয়, বেশ লাজুক। কিন্তু চোখের দৃষ্টি আর মিটিমিটি হাসিতে খুবই মুখরা। এভাবেই বেশ কিছুদিন যায়। সাজাদ টের পায় তার বাউন্ডেলেপনা আরো বেড়ে গেছে। সবসময় উদাস ভাব, কোনো কিছুতে মন দিতে পারে না। সামনে এক-দেড় মাসের মধ্যে বোর্ড পরীক্ষা।

একদিন সাজাদের অত্যন্ত প্রিয় মসিউর চাচা তাকে বলে, তোর সাথে জরুরি কথা আছে।’ মসিউর সাজাদের আপন চাচা নয়, তার বাবার চাচাত ভাই। তবে সে চাচার অন্ত:প্রাণ, চাচা তাকে ভীষণ স্নেহ করে, ভালোবাসে জান দিয়ে। যে কোনো বিষয়ে চাচাই তার পরিত্রাতা, শুধু লেখাপড়া ছাড়া। মসিউর চাচার মাথা খুব ভালো, লেখাপড়ায় কেন যে এত খারাপ সেটাই তার কাছে বিস্ময়! কোনো ভনিতা না করে চাচা একদিন বলে, শোন, নেহালির সাথে আমার দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক। এখন একটা ঝামেলায় রাগ-অভিমান চলছে। শুনলাম তোর নাকি ওর সাথে খুব খাতির হয়েছে। প্রেমে পড়েছিস নাকি? পড়লে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল। তুই ভীষণ মেধাবী ছাত্র, অনেক ভালো রেজাল্ট করবি, তোকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন; অনেক বড় কিছু হবি, তোর মুখের দিকে সবাই চেয়ে আছি। আর তুই লেখাপড়া চুলায় দিয়ে প্রেম করে বেড়াচ্ছিস! আর প্রেম যদি করতেই হয়—দুনিয়ায় আর মেয়ে খুঁজে পেলি না!’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো চাচা বলে যায়। সাজাদ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকে যেন খুব কাছের কোনো আপনজন মারা গেছে, যেন তার স্বপ্নের সৌধ ধূলিসাৎ হয়ে গেছে! অনেকক্ষণ পর কোনো রকম সাজাদ বলে, ’আপনার ধারণা ঠিক নয়।’ মসিউর বলে, তোর কাছ থেকে কিছু শুনতে চাই না।’ আশা করি এর পর থেকে হিসেব করে চলবি।’ এর পর বেশ কিছু সময় গেলে চাচা-ভাতিজা পাড়ার সিগারেটের দোকানে গিয়ে দু’টা ক্যাপস্টান নিয়ে মুরু্ব্বিদের আড়াল করার জন্য দোকানের পিছনের দিকে যায়। সাজাদ মাটির দিকে মুখ করে আর মসিউর আকাশের দিকে মুখ করে সিগারেট টানতে থাকে। এভাবে তাদের সিগারেট শেষ হতে থাকে; কিন্তু কোনো কথোপকোথন চলে না।

কয়েক দিন হলো সাজাদ আর পড়তে যায় না। এ কয়দিনে তার মনের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্বযুদ্ধ ঘটেছে, ভয়াবহ প্রলয় বয়ে গেছে; বিদ্রোহ করতেও চেয়েছে। কিন্তু শেষমেশ নিজেকে সামলে নিতেই হয়েছে। অনেকটা অনাগ্রহ নিয়ে সাজাদ আবার পড়তে যায়। সেদিনই নেহালির সাথে দেখা হলে, মনে না চাইলেও, নিজেকে কষ্ট বা শাস্তি দেওয়ার জন্যই অনেকটা জেদ করে তাকে সরাসরি চাচি বলে সম্বোধন করে বসে। এতে নেহালির একটা ভাবান্তর হয়, সেটা খুশির না বিরক্তির তা তার চোখ-মুখ দেখে বুঝতে পারে না। এভাবে কয়েকদিন গেলে সাজাদ বুকে ভীষণ হাহাকার নিয়েও নিজেকে পুরোপুরি সামলে নেয়। এর মাঝে চাচাও তার সাথে মাঝে মাঝে আসে। রাজু স্যারের সাথে মসিউর চাচার খুব খাতির। সাজাদ পড়ে, আর চাচা রাজু স্যারের সাথে গল্প করে। মসিউর সাজাদের ওপর পুরোপুরি আস্থা রাখে। নেহালির সাথে মসিউরের ঝামেলাটাও শেষ হয়। এখন তাদের মধ্যে নিয়মিত দেখা সাক্ষাৎ ও গল্প চলে। নেহালির আরেক বান্ধবীর বাসার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বা কোথাও বসে কয়েকজন মিলে গল্প করে, আড্ডা মারে। যেতে নির্লিপ্ততা প্রকাশ করলেও, মসিউর সাজাদকেও অনেকটা জোর করেই মাঝে মাঝে সেখানে নিয়ে যায়। এর মধ্যে একদিন মসিউর জানায়, সে ভারতে যাবে দশ-পনের দিনের জন্য। যাওয়ার আগে মসিউর সাজাদকে বলে যায়, ’আমি যখন থাকবো না তুই এসে তোর চাচিদের সাথে আড্ডা মারিস। ওর একা একা ভালো লাগবে না।’ মসিউর চলে গেলে সাজাদ চাচার কথা মতো আড্ডায় যায়, যাওয়ার জন্য অনেকটা তাড়নাও বোধ করে। কিন্তু কী কারণে এমন হয় ঠিক বুঝতে পারে না—হয়তো পুরোনো দুর্বলতা মনের মধ্যে সুপ্ত আগ্নেয়গিরি হয়ে আছে। প্রায় প্রতিদিন বিকালে গিয়ে চাচির সাথে গল্প করে। পাড়ার অনেকেরই সেটা চোখে পড়ে। কেউ কিছু মনে করে বলে মনে হয় না। এর একটা কারণ হয়তো—সাজাদদের পরিবারের সামাজিক অবস্থান, অত্যন্ত মেধাবী ও সুবোধ হিসাবে তার ভাবমূর্তি।

এর মধ্যে একদিন নেহালিদের পাড়ার এক ছেলে সাজাদের সাথে দেখা করে বেশ কিছু কথা বলে। সে কথা শুনে সাজাদ বেশ চিন্তায় পড়ে যায়। মোস্তাক সাজাদের থেকে পাঁচ-ছয় বছরের বড়। বছর দুয়েক হলো সে সেনাবাহিনীতে চাকরি পেয়েছে। ছুটিতে বাড়ি এসেছে। প্রথম দিন সে সাজাদকে অনেক ভালো ভালো কথা বলে জ্ঞান দেয়। বলে, ’তুমি খুব ভালো ছেলে, কত মেধাবী ছাত্র! তুমি লেখা-পড়া করে কত বড় হবা, তোমাদের পরিবারে কত সুনাম। তোমার এমন কিছু করা উচিত না যাতে তোমার পরিবারের দুর্নাম হয়। কয়েকদিন পরে আবার সে দেখা করে আগের দিনের মতো বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলে। একথা সেকথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে জিজ্ঞাসা করে, তুমি কি নেহালিকে ভালোবাসো?’ সাজাদ খুব অবাক হয়, তবু পরিষ্কার করেই কোনো সম্পর্ক নেই বলে তাকে জানায়। তখন মোস্তাক জিজ্ঞাসা করে, তুমি নেহালির সাথে প্রতিদিন গল্প করতে আসো কেন? সাজাদ এতে খুব রাগান্বিত হলেও ঠাণ্ডা মাথায় নরম করেই বলে, এমনিই আসি, শুধু গল্প করতেই আসি।’ সাজাদের মনে হয় মোস্তাক তার উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারেনি; সে সন্দেহ বজায় থাকে। তবে সাজাদ পরিষ্কার বুঝতে পারে মোস্তাক নেহালিকে ভীষণ পছন্দ করে, একপক্ষীয়ভাবেই করে, খুব ভালোবাসেও। বিয়ে করতে চায়। এর মধ্যে বোধহয় চেষ্টা তদবিরও করে চলেছে। নেহালি সম্ভবত কোনো পাত্তা-টাত্তা দেয়নি। তাছাড়া মোস্তাকদের সামাজিক অবস্থা নেহালিদের অনেক নিচে। কিন্তু সে নাছোড়, লেগে আছে। বিষয়টা সাজাদ একদিন নেহালিকে জানায়। নেহালি হেসে বলে, আর বলো না, ও-তো বহুদিন ধরেই আমার পিছনে লেগে আছে। ওর মা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমাদের বাড়িতে প্রস্তাবও দিয়ে গেছে। কোথাও কোনো পাত্তা পায়নি। তোমার চাচাও বিষয়টা ভালো করেই জানে।

সাজাদদের বাড়িটা শহরের পূর্ব-পশ্চিম প্রধান সড়কের ধারে প্রায় এক বিঘা জায়গার ওপর। বাড়ির মূল গেটটা শহরের প্রধান সড়ক থেকে উত্তর বরাবর নেমে যাওয়া গলি রাস্তার ওপর। তাদের বাড়ির ঘরগুলো পূর্ব-পশ্চিম বরাবর। অনেকটা স্কুল ঘরের মতো লম্বা। সাজাদ যে ঘরে থাকে সেটা একেবারে পূর্ব প্রান্তে রাস্তার উপর। টয়লেট মূল ঘরগুলো থেকে বেশ খানিকটা দূরে অবস্থিত, একেবারে পশ্চিম দিকের সীমানা ঘেঁষে। সাজাদের বদ অভ্যাসের মধ্যে একটা হলো—খুব অলস ও ঘুম কাতুরে। খুব ভোরে প্রস্রাবের চাপে ঘুম ভেঙে গেলে আলসেমী করে টয়লেটে যায় না। দরজা খুললেই রাস্তার ওপারে বাঁশঝাড়। পুটুস আর ঢোলকলমির বেড়া দিয়ে ঘেরা। দ্রুত দরজা খুলে কোনো রকম রাস্তাটা পার হয়ে বাঁশঝাড়ের বেড়ার কোলে গিয়ে বসে। জলবিয়োগ সেরে দ্রুত ফিরে এসে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। এই ঘটনাটা তার অনেকটা আধোঘুমন্ত অবস্থাতেই ঘটে।

এমনই একদিন জলবিয়োগ সেরে ফিরতেই দরজায় সাজাদের চোখ আটকে যায়। নিমিষেই ঘুম উধাও। বিস্ময়ে হতবাক! চোখের পলক আর পড়ে না । একটা রঙিন কাগজে বড় বড় হরফে কিছু লেখা দেখে। বারে বারে পড়েও তা কিছুতেই মাথায় ঢুকাতে পারছে না। তার মনে হয় সে কোনো দুঃস্বপ্নের মধ্যে আছে। যখন সে ধাতস্থ হয় তখনও তার মাথা পুরোপুরি কাজ করে না। বেশ খানিক সময় স্থানু হয়ে থেকে আঙ্গুল লাগিয়ে এক টানে পোস্টারটা ছিড়ে ফেলে। যাতে কেউ বুঝতে না পারে সেখানে কী লেখা ছিল। তারপর ঘরে ঢুকে খাটে বসে ভাবতে থাকে। কেউ যদি দেখে থাকে, কী হবে এখন! পুরা এলাকার লোক ভুল জানবে, তার পরিবার জানবে, নেহালির পরিবার জানবে। পরিবারের সামনে দাঁড়াবে কী করে, পাড়ায় বের হবে কী করে! আর মসিউর চাচা-ই বা কী মনে করবে। সে কি বিশ্বাস করবে, তার সাথে নেহালির কোনো সম্পর্ক নেই। রাজ্যের সব দুঃশ্চিন্তা মাথাটা ভরে যায়। এভাবেই অনেক সময় চলে যায়। ভাবতে থাকে কে এই সর্বনাশ করতে পারে! সবার আগে সন্দেহে এলো মোস্তাকেরই নাম। সেই পারে নেহালির নামে দুর্নাম ছড়ানোর জন্য এ কাজ করতে। যাতে তার নেহালিকে পাওয়া সহজ হয়। সাজাদ তাকে বুঝাতে পারেনি যে নেহালির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। মোস্তাক তার পুরো ছুটির মধ্যে প্রায় দিনই দেখেছে নেহালি আর সাজাদকে গল্প করতে। এভাবে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার মাথায় আসে, এমন পোস্টার তো নেহালিদের বাড়ির গেটেও লাগাতে পারে। তখনও পুরোপুরি সকাল হয়নি। মানুষজন ঘর থেকে বের হয়নি। সাজাদ তখনি বের হয়ে যায়। বেশি দূর না যেতেই চোখে পড়ে সাজাদদের বাড়ির সীমানা প্রাচীরে লাগানো আরেকটা পোস্টার। কাছে গিয়ে দ্রুত সেটা ছিড়েই রুদ্ধশ্বাসে রওনা দেয়। প্রধান সড়কে উঠেই চোখ পড়ে বিদ্যুতের খাম্বায়। সেখানেও দেখে একটা লাগানো। ছিড়তে ছিড়তে সাজাদের ধারণা হয়, নেহালিদের বাড়ি পর্যন্ত পুরো পথেই চোখে পড়ার মতো সব জায়গায় পোস্টার লাগানো হয়েছে। আরেকটু সামনে গিয়ে যখন তার চোখ পড়লো রাস্তার ধারের বড় সেগুণ গাছটায়। তার ধারণা তখন আরো পোক্ত হয়। এভাবে একটু করে এগোয় আর একটা করে পোস্টার পেতে থাকে । তড়িঘড়ি করে তা ছিড়তে থাকে। তার অস্থিরতা শুরু হয়, বুকধড়পড়ানি বাড়তে থাকে। শুধু মনে হয় কোনোটা এড়িয়ে গেলো না তো! তবু যত দ্রুত সম্ভব পা চালাতে থাকে। পুরো রাস্তা জুড়ে লাগানো সব পোস্টার কেউ দেখার আগেই তাকে ছিড়ে ফেলতে হবে। নিশ্চিত হয় নেহালিদের বাড়ির গেটেও একটা পোস্টার লাগানো আছে। সে পর্যন্ত না যেতে পারলে রক্ষা নেই। মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে, এ যাত্রায় সে যেন রক্ষা পায়। যেতে যেতে যখন একেবারে নেহালিদের বাড়ির কাছে পৌঁছায়, তখনো রাস্তায় লোক খুব একটা বের হয়নি। যারা বের হয়েছে হয়তো তাদের চোখে পড়েনি বা তারা লেখাপড়াজানা লোক নয়। নেহালিদের বাড়ি থেকে অল্প দূরে, ইলেক্ট্রিক খাম্বারটা ছিড়ে ফেলে তার মনে হয়, এ যাত্রায় বোধ হয় বেঁচে যাচ্ছে। বাড়ির একেবারে কাছে পৌঁছে যায়। কিছুটা দূর থেকেই দেখতে পায়, ঠিকই পোস্টারটা আছে। আর কয়েক কদম গেলেই গেট স্পর্শ করবে। ঠিক তখনই শুনতে পায় দরজাটা কেউ ভিতর থেকে খুলছে। দেখে স্বয়ং নেহালির বাবা আসশেওড়ার একটা দাঁতন হাতে বের হয়ে আসছে। একে বারে সামনা সামনি পড়ে যায়। সাজাদ কিছুটা হতচকিয়ে যায়। নেহালির বাবা দেখা হলেই, সাজাদের বাবার সঙ্গে সম্পর্কের সূত্র ধরে নাতি সম্পর্কিত বিভিন্ন সম্বোধন করে ডাকে। সাজাদ কে বলে, কী রে শালা, এত সাত সকালে কোথায় যাস।’ সাজাত থতমত খেয়ে একটা কাজ আছে বলে দ্রুত পা চালায়। কিন্তু মাথা তার শূন্য। তীরে এসে তরী ডুবে গেল! দরজায় লাগানো পোস্টারে বড় বড় করে সাজাদ ও নেহালিকে জড়িয়ে এমন করে লেখা যা কারোর বুঝতে এক মুহূর্ত দেরি হবে না । দাঁতন শেষ করে বাড়িতে ঢুকতেই নেহালির বাবার চোখে সেটা পড়বেই। এর পরের ঘটনা প্রবাহে নেহালি ও নিজের ভয়াবহ পরিণতিগুলো সাজাদের চোখে দৃশ্যমান হয়ে ওঠতে থাকে। সেগুলো নিয়ে ভাবতে ভাবতেই দ্রুতলয়ে অন্য পথে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে।