শীতের পাখি

Writer: Rina Gulshanara Category: ছোট গল্প (Short Story) Edition: Dhaboman - Winter 2017

শীতের পাখি

 

রীনা গুলশান

 

 

 তুমি যদি কথা বল, সমুদ্র সৈকতে বালিয়াড়ি

আগ্রহে চঞ্চল হয়, যদি সুর ভেসে আসে তারই

তুমি যদি গান গাও, সে গানে বিহঙ্গ পাথা নাড়ে

তোমার কাকলি শুনে শীতার্ত বৃক্ষেরা পাতা ছাড়ে।

 

কাজে যাবার সময় প্রায় প্রতি দিনই রুজ হিল স্টেশন এসে লেক ওন্টারিওর দিগন্ত ব্যাপি জলরাশি দেখে আমার কবিত্ব জেগে ওঠে। GO ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে এই অপুর্ব দৃশ্য দেখে আমি বরাবরই খুব আনমনা হয়ে যাই। এমনিতেই পানি আমাকে বড়ই টানে। গত আট বছরে খুব কম দিনই আছে যখন আমি এখানে এসে মনে মনে কবিতা আবৃত্তি করি নি। কোন কোন সময় তো গানও গেয়ে উঠি। আজও আমার অনেক প্রিয়, কৃষ্ণধর এর এই কবিতাটা মনে মনে আবৃত্তি করছিলাম আর চারদিকের দ্রুত বদলে যাওয়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম।

এইতো মাত্র মাস দুই-তিন আগেই সবুজ পাতায় ছেয়ে ছিল গাছপালাগুলো। কি অপরূপ দেখাত! দেখতে দেখতে হঠাৎ করেই যেন সবুজ পাতাগুলো হলুদ হয়ে গেল। সেই বিবর্ণ পাতাগুলো আচমকা বাদামী বর্ণ ধারন করে অচিরেই ঝরে পড়ে গেল শীতের আগমনে।

 রুজ হিল সংলগ্ন লেক ওন্টারিওর সৈকতটা বড়ই সুন্দর।   সামুদ্রিক সৈকত না হলেও দেখে সেই রকমই মনে হয়। বিশেষ করে আকাশ যেদিন বেশ মলিন থাকে আর হাওয়া খুব জোরে বয়, তখন সৈকতে ঝাঁপিয়ে পড়া উত্তাল ঢেউয়ের খেলা দেখে তেমনটাই মনে হয়।

আমার কবি কবি ভাব অকস্মাৎ একটি ফোঁপানির শব্দে ছিন্ন হল। তাকিয়ে দেখলাম আমার বিপরীত পাশের সীটে বসে থাকা মহিলাটা ফোঁপাচ্ছে। একটু আগে তাকিয়ে দেখেছিলাম মহিলা সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে। চোখ বোজা ছিল। বড়ই ক্লান্ত লাগছিল। বয়েস হয়ত ত্রিশ-বত্রিশ। মনে মনে ভেবেছিলাম, এখনই ক্লান্ত বৎস, মাত্র তো কাজে যাবার সময় হল। সারা দিনতো পড়েই রয়েছে। পরে কি করবে? অযথা তাকে বিরক্ত না করে আমি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মনঃনিবেশ করেছিলাম। হঠাৎ ফোঁপানীর শব্দ শুনে চকিতে মহিলার দিকে তাকালাম। দেখলাম সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে কাঁদছে সে। হয়ত প্রথম থেকেই কাঁদছিল, আমি খেয়াল করিনি। এখন শব্দ করায় ধরা পড়ে গেছে। মানুষ যখন তার দুঃখের ভার আর বইতে পারে না তখন এইরকম অসহায়ের মত কাঁদে।

আমি বেশ কিছুক্ষন নিঃশব্দে তাকে পর্যবেক্ষন করে কোন প্রশ্ন করা থেকে নিজেকে নিবৃত করবার চেষ্টা করলাম। বুঝতে পারছি না মহিলা কিভাবে নেবে। কিন্তু পরিশেষে মানবতার জয় হল। আমি দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে তার পাশে গিয়ে বসে তার কাঁধে একটা হাত রেখে সহানুভূতি জানিয়ে কয়েকটা টিসু এগিয়ে দিলাম। সে টিসুগুলো সাগ্রহে নিল এবং আমাকে ধন্যবাদ দিল। আমি ওকে ধাতস্থ হতে একটু সময় দিলাম। অবশেষে বললাম, “কি হয়েছে? জানি এটা মোটেই এদেশীয় ভদ্রতা নয় কিন্তু তুমি আমার মেয়ের বয়েসী হবে। তাই তোমার কান্না দেখে নিজেকে সামলাতে পারছি না। যদি কিছু মনে না কর...”

“না না আমি কিছু মনে করছি না...বিশ্বাস কর...বিশ্বাস কর আমার এই মুহুর্তে তোমার মতই কাউকে দরকার ছিল। কিন্তু আমার মুখ থেকে কিছু শোনার আগে তুমি বরং এটা দেখ।” সে একটা বেশ বড় সড় খাম আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “আমি কামিলা”।

আমিও আমার নাম বলে ওর বাড়িয়ে দেয়া খামটা নিলাম।

ওটা খুলে দেখলাম একটা উকিলের নোটীশ। ডিভোর্স পেপার। কোন এক এন্ডারসন নামের কেউ একজন ডিভোর্স চাচ্ছে। “তোমার স্বামী? তুমি আগে থেকে জানতে না?”

কামিলা এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ল। ডিভোর্স শব্দটার প্রতি আমার এমনিতেই যথেষ্ট এলার্জি আছে। ইদানীং সেটা ঘৃণার দিকে টার্ন নিয়েছে। “কি ব্যাপার? কেন? কিভাবে?” একসাথে অনেকগুলো প্রশ্ন করে ওকে বিব্রত করলাম।

“ব্যাপারটা এইরকম যেন উল্টো বললি রাম,” কামিলা বলল। “মানে, আমারই ওকে ডিভোর্স দেবার কথা ছিল। কিন্তু নানান কারণে সময় এবং সুযোগ মিলছিল না। আমার সাথে এন্ডির বিয়ে হয়েছে ৮ বছর। তবে পরিচয় চৌদ্দ পনের বছরের। দু’ জনাই ডাউন টাউনে চাকরী করি। ব্যাংকে। আমি RBC ব্যাংকে। ও TD ব্যাংকে। পরিচয় আমাদের একজন কমন বন্ধু রফির মাধ্যমে। সেই ১৫ বছর আগে। ধীরে ধীর পরিচয় কখন যে গাঢ় হল জানি না। কিছুদিন একসাথে বসবাসও করেছিলাম। বিয়ের জন্য এন্ডিই তাড়া দিচ্ছিল। হুইটবিতে আমার একটা বাড়ী আছে। অনেক আগের কেনা, ৩ বেডরুমের। অনেক জায়গা নিয়ে বাড়ী। ডাউন পেমেন্ট ত্রিশ হাজার ডলার আমার বাবাই আমাকে দিয়েছিল। আমি তাদের একমাত্র কন্যা। বাড়ীটা আমারই নামে।

“তো বিয়ের পর এন্ডি আমার বাড়িতেই উঠে এলো। আমার বাবা মা ব্যারী তে থাকে। ওখান থেকে প্রায়শঃই চলে আসে। কিছুদিন থেকেও যায়। বিয়ের পর থেকেই আমরা দুজনেই বাচ্চা চাচ্ছিলাম। আমার পর পর তিনটা মিস ক্যারিয়েজ হয়ে গেল। তিন নম্বরটাতো ৪ মাসের ছিল। আমি খুব ভেঙে পড়েছিলাম। এরপর গত বছর আবার প্রেগনেন্ট হলাম। এরপরই শুরু হল বিভিন্ন রকমের সমস্যা। বমিতো প্রায়ই হচ্ছিল। প্রথম থেকেই তল পেটেও খুব ব্যাথা হত। কিন্তু তারপরও আমি যেভাবেই হোক বাচ্চাটা রাখতে চাইছিলাম। ৬ সপ্তাহ পর ডাক্তার নিশ্চিত করল আমার টুইন বেবি। আমার খুশীও ডাবল হল। তবে এবার বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দিল। কাজে যেতে মানা করল। স্বামীর সাথে সহবাস করতে মানা করল। আমার মা আমার কাছে চলে এলো সাহায্য করবার জন্য। বাবা আসা যাওয়া করত। 

“এন্ডি খুব খুশী। ৪ মাস পরে আমরা জানলাম, একটা ছেলে, একটা মেয়ে। সবাই মিলে নামও ঠিক করে ফেললাম। ছেলে এডিসন এবং মেয়ে হলে ইনায়া। সব কিছু সুন্দর চলছিল। যদিও এন্ডি প্রায়ই দেরী করে বাসায় ফিরতে শুরু করেছে। বললেই একটা না একটা বাহানা করত। আমিও যে এন্ডির ব্যবহার নিয়ে খুব একটা চিন্তিত ছিলাম তাও না। ওকে আমি আমার ডান হাতের মত বিশ্বাস করতাম। যাই বলত তাই চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতাম। আমাদের লিভিংরুমে একটা সোফা কাম বেড ছিল। সেটা আমাদের বেডরুমে নিয়ে এলো এক রাতে। এক বিছানায় না শুয়ে সেখানে শুতে শুরু করল। আমাকে বলল, ‘তোমার পাশে শুলে আমার নানা রকমের অসুবিধা হচ্ছে। আলাদা শুলে তোমার জন্যেও ভালো, আমার জন্যেও ভালো’।

“আমি খুব মনক্ষুন্ন হলাম। কিন্তু কিছুই বলিনি। কারণ তখন অনাগত শিশুদের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। আমি এন্ডির উপেক্ষাকে পজিটিভ ভাবেই নিয়েছিলাম। মানুষ যখন পূর্ণ প্রাপ্তির ভারে ন্যুব্জ থাকে তখন তাকে কিছুই আর দংশন করতে পারে না।

“এর মধ্যেই একদিন এন্ডির খুব ভালো বন্ধু , আমাদের কমন বন্ধু, রিকি ফোন করে অনেক কিছু বলল এন্ডির নামে। ওদের অফিসে একটা ফিলিপিনো মেয়ে আছে যার নাম এলেনা। তার সাথে নাকি এন্ডি প্রায়ই বাইরে চলে যায়। আমি রাতে এন্ডিকে ধরলাম। এন্ডি আমাকে সুন্দর একটা কাহিণী বলে, উলটা আমাকেই দোষারোপ করল। তুমি আমাকে অবিশ্বাস করছ, হানি? বলেই বহুদিন পরে সে আমাকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিল। আমার তৃষ্ণার্ত মন ভরে গেল। ভুলে গেলাম সব অনাহুত কথা। এন্ডি এটাও বলল, এন্ডির প্রমোশন হয়েছে বলে রিকি তাকে খুব হিংসা করছে। ওটা নাকি রিকিরই পাবার কথা ছিল। আমি বরাবরের মতই এন্ডিকেই বিশ্বাস করলাম।

“কিছু দিন পর প্রথম বারের মত আমার কোল আলো কর একসাথে দুটা বেবী 

এলো। ইনায়া এবং এডিসন। এডিসন একটু দূর্বল হয়েছিল। ওকে নিয়ে খুবই ব্যাস্ততার মধ্যে দিন রাত্রি অতিবাহিত হচ্ছিল। এন্ডি মাত্র ৭ দিনের ছুটি নিল। ইচ্ছে করলে সে এক মাস ছুটি নিতে পারত। বাচ্চা হবার পর আমাদের বেডের পাশেই একটা ক্রিব রেখেছিলাম। ভাগ করে দুই বাচ্চা ঘুমাত। প্রথম দুই মাস এডিসন সারা রাত কাঁদত। এভাবে কয়েক সপ্তাহ চলার পর এন্ডি অন্য ঘরে ঘুমাতে চলে গেল। যাবার সময় গম্ভীর মুখে বলে গেল, সকালে অফিস থাকে। কান্নাকাটিতে ঘুমের অসুবিধা হচ্ছে।

“আমার চীৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছিল – এরা কি তোমার বাচ্চা না? এতো সাধের বাচ্চা, এতো কষ্টের বাচ্চা! সেই স্বপ্নের বাচ্চাদের কান্নাও তুমি সইতে পারছ না? একদিন এরাই তোমাকে বাবা বলে ডাকবে। কিন্তু কিছুই বলিনি। পাশের রুমেই মা ইনায়াকে নিয়ে আছে, শুনতে পাবে। এমনিতেই মা ইদানীং এন্ডির ব্যবহারে খুব বিরক্ত ছিল।

“এর মধ্যে গত মাসে আমার ছোট বেলার বন্ধু লুইজা হঠাৎ করেই বিনা নোটিসে বাসায় চলে এল। বাচ্চাদের দেখতে আরোও দুই বার এসেছে। বেশ গম্ভীর। একথা সে কথার পর হঠাৎ বলল, ‘কামিলা, আমি গত সপ্তাহে টরন্টো ডাউনটাউনে কিং এবং স্প্যাডিনার একটা হাই রাইজ বিল্ডিং  এ বেড়াতে গিয়েছিলাম। ওখানে ১৬ তলায় আমার দুঃসম্পর্কের একজন বোন থাকে। বিকাল ৫ টার দিকে যখন তার বাসা থেকে বের হচ্ছি তখন দেখি ঠিক মুখোমুখি এপার্টমেন্টের দরজা খুলে এন্ডি আর একটা মেয়ে ঢুকছে। আমি নিশ্চিত হবার জন্য দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ভালো করে দেখলাম। ওটা এন্ডিই ছিল। তবে মেয়েটাকে চিনিনা।’

“আমি মেয়েটার বিবরণ শুনেই বুঝলাম সে এলেনা। আমার মাথায় এবার সত্যিই আকাশ ভেঙে পড়ল। আমার বাচ্চাদের বয়েস মাত্র ৭ মাস। পর দিনই লুইজার সাথে ওর বোনের বাসায় গেলাম। ভেতর থেকে কি হোল দিয়ে বাইরে নজর রাখছিলাম। ঠিক সাড়ে ৫ টার দিকে ওদের দু’জনকে ঢুকতে দেখলাম। ঘন্টাখানেক পর সাহস সঞ্চয় করে আমরা দুই বান্ধবীতে গিয়ে দরজায় নক করলাম। দরজা খুলল এলেনা। আমাকে দেখে ভুত দেখার মত চমকে গেল। আমি বললাম, ‘এলেনা কেমন আছো?’ বলতে বলতেই ওকে একরকম ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। তারপর সোজা ওর বেডরুমে। দেখি এন্ডি শোবার পোষাক পরে বিছানায় শুয়ে আছে। আমাকে দেখেই ‘তুমি?’ বলে চীৎকার করে দাঁড়িয়ে গেল।

আমি কোন জবাব না দিয়ে সেখান থেকে ছুটে বেরিয়ে আসি। কিভাবে যে বাসায় ফিরে এসেছিলাম বলতে পারি না। লুইজাই ড্রাইভ করে পৌঁছে দেয়। মা বলল, ‘আমার অনেক আগে থেকেই সন্দেহ হচ্ছিল’।

“তারপর একজন বন্ধু পাঠিয়ে তার জিনিষ পত্র নিয়ে যায় এন্ডি। গতকাল এই চিঠি দিয়েছে। সবাই আমাকেই ডিভোর্স লেটার পাঠাতে বলেছিল। আমিই পারছিলাম না। কি জানি কেন? কি এক অজানা কষ্ট আমাকে বাঁধা  দিচ্ছিল।”

কামিলার দুই চোখ বেয়ে আবার অশ্রু ঝরতে শুরু করেছে। আমি নিঃশব্দে আরও কয়েকটা টিসু পেপার এগিয়ে দিলাম। দুরন্ত বেগে ছুটে যাওয়া ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম এক ঝাঁক পাখীরা ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে দিগন্তের দিকে উড়ে যাচ্ছে। হয়ত উষ্ণতার জন্য ছুটছে। জীবনটা কি শীতের পাখীর মত?