Table of Content

Jasim Mallik
NA
NA
7 articles

স্মৃতিকথা - একজন স্বপ্নবাজ

লেখক: জসিম মল্লিক Category: আত্মজীবনী (Memoir) Edition: Dhaboman - Eid 2017

 

বাইরে ঝির ঝিরে বৃষ্টি এবং তার সাথে কন কনে ঠান্ডা। এই শহরে কখন যে সকাল হয় কে জানে! দুনিয়ার সবচেয়ে দামী এলাকা বেভারলি হিলসের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি আমরা। ভোর সাড়ে পাঁচটা। গাড়ি ছুটে চলেছে মসৃন রাস্তা দিয়ে। গাড়ির ভিতর যদিও উষ্ণতা বিরাজ করছে তা সত্বেও আমি শীতে কম্পমান। প্রশান্ত মহাসাগরের কাছে বলে ঠান্ডা তেমন অনুভব করে না এখানকার মানুষ। চারিদিকে একটা ভুতুরে নিরবতা। এই ভোর রাতে কে আর রাস্তায় বের হবে? ছটার মধ্যে আমাদের পৌঁছতে হবে বিখ্যাত কোডাক থিয়েটারে। অন্তত তিন স্তর বিশিষ্ট নিরাপত্তা বেষ্টনি পার হতে হবে বলে জানি। আমি একটু ভয়ও পাচ্ছি। ডর ভয়ের ভিতর দিয়েই আমি বড় হয়েছি। ৯/১১ এর জুজু আমেরিকাবাসীকে গিলে খেয়েছে তখন।
সেটা ছিল ২০০৩ সাল। সম্ভবত মার্চ মাস। আমি এসেছি বেড়াতে। আমার সঙ্গে সবুজ পাসপোর্ট। কিন্তু আমি তাতে গর্বিত। অনেকেই আমাকে ভয় দেখাচ্ছিল লসএঞ্জেলেস এয়ারপোর্ট খুউব খারাপ জায়গা। সবুজ পাসপোর্ট দেখলে আমাকে ঢুকতেই দেবে না। ফিরিয়ে দেবে। আমি এসব কথায় কান দেয়ার লোক না। কেনো আমাকে ফিরিয়ে দেবে! আমি একজন ভদ্রলোক। আমার কোনো ক্রিমানাল রেকর্ড নাই। আমাকে কে ফেরায়! ভিসাতো অমেরিকান এ্যাম্বাসি ইস্যু করেছে। তাও পাঁচ বছরের। এর আগেও আমি যে এদেশে আসিনি তাতো না। ৯/১১ এর আগে আগেই আমি একবার ঘুরে গেছি। সুতরাং অন্যদের কথায় আমি কেনো কান দেবো! আমি প্রতিটা মানুষের কথা খুউব মন দিয়ে শুনি। বুঝদারের মতো মাথা নাড়াই। কিন্তু আমি আমার নিজের মতো করে চলি। আমার নিজস্ব কতগুলো বিবেচনা আছে। আমি অতি সাধারন একজন মানুষ হওয়া সত্বেও ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ অতি সম্মানের সাথে আমাকে সে দেশে বেড়ানোর সম্মতি দিল।
আমরা কোডাক থিয়েটারে যাচ্ছি অস্কার নমিনেশন পোগ্রামে। সেখানে হলিউড তারকাদের মেলা বসবে। আমি তাদের সামনে থেকে দেখব! ভাবা যায়! আমার কাছে ব্যাপারটা অবিশাস্যই বটে। যারা বড় বড় মানুষ তাদের কাছে হয়ত এটা কোনো ব্যাপার না। কিন্তু আমার কাছে একটা স্বপ্নের মতো। আর কিছুক্ষনের মধ্যেই ব্যাপারটা ঘটতে যাচ্ছে। আমি মুনাওয়ার হুসেন পিয়ালের সাথে মার্সিডিস গাড়িতে চড়ে হলিউডের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি! আমার মনে পড়ছে যখন আমি খুউব ছোট ছিলাম তখন ভাবতাম কবে আমি গাড়িতে চড়তে পারবো! বরিশালের রাস্তা দিয়ে দু’একটি গাড়ি চলত। টয়োটা স্টারলেট, ট ুডোর গাড়ি। তাতে চড়ে ঘুরে বেড়াতো অফিসের বড় সাহেব আর তাদের রুপসী কন্যারা। আমি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে তাদের দেখতাম। ভাবতাম এসবতো ওদেরই মানায়!
গাড়ি নিয়ে আমার অনেক অবসেশন আছে। আমি তখন মহসিন হলের ৬৫৫ নম্বর রুমে থাকি। সিঙ্গেল রুমে । রাস্তার দিকে ছিল আমার রুমটি। রাস্তার দিকে তাকিয়ে আমি গাড়ি চলা দেখতাম। এটা একটা অভ্যাসের মতো হয়ে গিয়েছিল। তখন মালয়েশিয়ান একটি গাড়ি চলত ঢাকার রাস্তায় । নাম ছিল প্রোটন সাগা। নামটা আমার এমন ভালো লেগে গেলো। তখন আমি গাড়ির মাথা মুন্ড কিছুই বুঝি না। শুধু নামের কারনে আমি গাড়িটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। মনে মনে ভাবি আমার কী এরকম একটা গাড়ি কোনোদিন হবে! তখন আমার এমন অবস্থা যে, কেউ যদি বলে চল আজকে এক জায়গায় দাওয়াত আছে আমি ছোক ছোক করি তার পিছনে পিছনে। কারন আমার পকেটে পয়সা নাই। হলের ডাইনিংএর কুৎসিত খাবার খেতে খেতে আমি ক্লান্ত! সেই আমি গাড়ির স্বপ্ন দেখি। আমি খুবই স্বপ্নবাজ মানুষ।
১৯৯৫ সালে আমি ধুম করে গাড়ির মালিক হয়ে গেলাম। আমার বন্ধুদের মধ্যে সবার আগে! না, নিজের পয়সায় না। আমার বস আমার কাজে খুশী হয়ে একটা গাড়ি কিনে দিয়েছিল। আমি যখন ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই তখন তিনি আমাকে দুটো বিষয় মনে রাখতে বলেছিলেন, এক- ভালো ড্রাইভিং জানলে কোনোদিন না খেয়ে থাকতে হবে না। দুই- গাড়ি যেনো সব সময় আমার কন্ট্রোলে থাকে। সত্যি সত্যি ভালো ড্রাইভিং এদেশে এসে আমার কাজে লেগেছে। আমি তখন অটোয়া থাকি। কিছুদিন পিজা ডেলিভারি করেছিলাম। আমার খারাপ লাগেনি তো! কাকতলীয়ভাবে আমাকে যে গড়িটা দেয়া হয়েছিল সেটাও ছিল টয়োটা স্টারলেট। এই গাড়িটা চালাতাম আর শৈশবের দেখা সেইসব রুপসী কন্যাদের কথা মনে হতো।
আমি একবার বরিশাল- খুলনা রুটের এক বাস ড্রাইভারের সাথে খাতির পাতিয়ে ফেললাম। মাঝে মাঝে বাসস্টপে গিয়ে বসে থাকি। কখন বাসটি আসবে। লোকজনকে জিজ্ঞেস করি। একদিন সেই ড্রাইভার চাচা আমাকে দোকান থেকে চমচম কিনে খাইয়েছিল। লম্বা চওড়া মধ্যবয়ষ্ক লোক। কাবুলিওয়ালার মতো। ওইরকম স্বাদের মিষ্টি আমি আর খাইনি। আমার উদ্দেশ্য ছিল একবার যদি বিনে পয়সায় সে আমাকে খুলনা নিয়ে যেতো তার বাসে চড়িয়ে! সত্যি সত্যি কিন্তু আমি খুলনা গিয়েছিলাম। সেদিন আমি মনে মনে ভেবেছিলাম বড় হয়ে আমি বাস ড্রাইভার হবো। কিন্তু আমার সে স্বপ্ন পূরন হয়নি। আজ সেই মানুষটির কথা খুব মনে পড়ছে। আমাদের বাড়ির সামনেই ছিল সিএন্ডবি রোড। সড়ক ও জনপথ বিভাগের অফিস। সেই অফিসের দুটো বড় বড় ট্রাক ছিল। হেভি ডিউটি ট্রাক। তারা রাস্তা মেরামতির কাজ করত। আমি বিকেল হলে তাদের অফিসের আশপাশ দিয়ে ঘুরতাম। যদি একবার ওটাতে চড়া যায়!
বিদেশ ঘোরার প্রতি আমার আগ্রহ জন্মায় বই পড়ে। অথচ আমি কোনোদিন জানতাম না যে আমি বিদেশ দেখার সুযোগ পাবো। আমি বরিশাল বসে ভাবতাম ঢাকা শহরটা কেমন! আমি কী কোনোদিন যেতে পারবো? কে আমাকে নিয়ে নিয়ে যাবে? আমার খালাত ভাই মোস্তফা প্রায়ই ঢাকা যেতো আর আমার কাছে গল্প করত। আমি কত তার হাতে পায়ে ধরেছি! আমাকে একটু ঢাকা নিয়ে যাও। কিন্তু সে আমাকে নিয়ে যায়নি। আমি মায়ের সাথে বরিশাল থেকে লঞ্চে চড়ে ঢাপরকাঠি যেতাম। মামা বাড়ি। মাত্র তিন ঘন্টার জার্নি। তাতে আমার মোটেও মন ভরতো না। আমি সারেং এর পাশে বসে লঞ্চের হুইল ঘোরানো দেখতাম। ভাবতাম লঞ্চ চালানো এমন আর কি কঠিন! আমি একদিন সারেংও হতে পারি।
প্লেন দেখলে আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে বিভোর হয়ে যেতাম! এখনও হই। ভাবতাম চলে যাবো। যেখানে খুশী। যাবো আর ফিরবো না। মায়ের জন্য আমার মন খারাপ হবে। কিন্তু আমি ফিরবো না। কোনো ফিরবো? আমি নিজেকে কোথাও প্রতিস্থাপন করতে চাই না। এখন সুদুর এই কানাডা বসে আমি আরো দুরে কোথায় চলে যেতে চাই। রফিক আজাদের কবিতার মতো বলতে হয়, ’চলে যাবো সুতোর ওপারে, সম্ভবত সেখানে সুখ, স্বাধীনতা আছে’। অথবা আমার মায়ের কোলে।
সেটা ১৯৭৬ সাল। আমার প্রথম ঢাকা দর্শন। মুগ্ধ হয়ে ঢাকা দেখি। কত গাড়ি, কত মানুষ, বড় বড় রাস্তা। সুন্দর সুন্দর নারী। একদিন গুলিস্তানের সামনে দাঁড়িয়ে রিক্সাওয়ালাকে বললাম, বাইতুল মোকাররম কোথায়! আামাকে নিয়ে যাবেন! রিক্সাওয়ালা আমাকে বাইতুল মোকাররম নামিয়ে দিয়ে বারো আনা আদায় করেছিল। অথচ ওটুকু পথ আমি হেঁটেই যেতে পারতাম। বারোআনা যে তখন আমার কাছে অনেক কিছু। সেবার ঢাকা থেকে বারিশাল ফেরার সময় আমার পকেটে একটা পয়সা নাই। শীতের রাত। প্রচন্ড খিদে এবং প্রবল জ্বর নিয়ে লঞ্চের ডেকে শুয়ে আসতে হয়েছিল আমাকে। সারারাত শীতে কেঁপেছি। কিন্তু কেউ আমার গায়ে একটা কাপড় পর্যন্ত জড়িয়ে দেয় নি। আশ্চর্য্য হলেও সত্যি সেই আমি প্রথম বিদেশ ঘুরতে যাই আমেরিকায়। স্কুল জীবনে শংকরের ’এপার বাংলা ওপার বাংলা’ বইটি পড়ে আমি কল্পনায় আমেরিকার রাস্তা দিয়ে হাঁটতাম। মনে মনে ভাবতাম আমি কী কখনও সেখানে যেতে পারবো? কেমন সেই দেশটি? সত্যি কি ওরকম একটা দেশ আছে?
সিনেমার প্রতি আমার নেশা প্রচন্ড। আমার মতো সিনেমা পাগল মানুষ খুব বেশী আছে বলে মনে হয় না। আমি যে জীবনে কিছু হতে পারিনি সিনেমা তার একটা কারন। আমার জীবনের অনেক সময় কেড়ে নিয়েছে সিনেমা। আমার মা চাইতেন আমি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার জাতীয় একটা কিছু হই। আর আমি যাকে যখন যেটা করতে দেখতাম সেটাই হতে চাইতাম। আমি জীবনে বিভিন্ন সময় যা যা হতে চেয়েছি তার একটা তালিকা দিচ্ছি- ১. নৌকার মাঝি ২. সারেং ৩. বাস ড্রাইভার ৪. দর্জি ৫. মেরিন ৬. সিনেমা হলের গেটম্যান এবং ৭. মালি। সবগুলোর পিছনেই একটা করে ছোট্ট ইতিহাস আছে। সে প্রসঙ্গে আজকে আর নাইবা গেলাম। সেবার হলিউডে অস্কার নমিনেশন প্রোগ্রামে যোগদান আমার কাছে একটা বড় আনন্দময় অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে। সে অনুষ্ঠানে হলিউডি অনেক তারকাদের সামনা সামনি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। সিনেমা দেখা নিয়ে অনেক গল্প আছে আমার জীবনে। আমি নিশ্চতভাবে জানি যে আমার জীবন থেকে মুগ্ধতা ব্যাপরটা কখনও যাবে না। যা কিছু দু’চোখ ভরে দেখি তাতেই মুগ্ধ হই। যেমন ’হলিউড’ কথাটা লেখা আছে যে পাঁচ হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ারের গায়ে সেখানে র্পযন্ত উঠেছিলাম।
আমার ছোটমামা একটু আজব টাইপরে মানুষ ছিলেন। থাকতেন ঢাপর কাঠি। অজগ্রাম। মাঝে মাঝে বরিশালে আমাদের বাড়িতে আসতেন। মামা সে সময় একমাত্র মেট্রিক পাশ মানুষ ছিলেন পুরো গ্রামের মধ্যে। মেট্রিক পাশ বলে একটু দাপুটে ছিলেন। বেশ সৌখিন মানুষ। কিন্তু মামা জীবনে কিছুই করতে পারেন নি। সারা জীবন বসে বসে খেয়েছেন। মামা আমাদের বাড়িতে এলে একটা উৎসব উৎসব ভাব চলে আসতো। মা ব্যস্ত হয়ে পড়তেন ছোট ভাইকে কী খাওয়াবেন এইসব নিয়ে। আমিও মহা খুশী হতাম। কারন মামা যে ক’দিন থাকতেন আমার পড়াশুনা করতে হতো না। মামার পিছন পিছন ঘুরতাম। মা কিছু বললে মামা প্রোটেকশন দিতেন।
তখন আমি দশ বছরের বালক। মামা একদিন আমাকে চুপি চুপি বললেন সিনেমায় যাবি? শুনে আমার বুকের মধ্যে দশটা ব্যঙ লাফ দিয়ে উঠল! সিনেমায়! আমি স্কুলে যাওয়ার সময় দেখতাম রিক্সায় মাইক লাগিয়ে কী সুন্দর করে সিনেমা মুক্তি পাওয়ার কথা বলছে..”আজ ম্যাটিনি শোতে সোনালী সিনেমায় চলবে রহমান শবনাম অভিনীত..” দেয়ালে দেয়ালে নায়ক নায়িকার ছবিসম্বলিত পোষ্টার। আমি সেদিকে তাকিয়ে থাকি। সিনেমা জিনিসটা যে কেমন! কবে যে দেখতে পাবো! কয়েকবার সিনেমা হলের সামনে দিয়ে ঘুরেছি। ওই বয়সে আমার সিনেমা দেখা ছিল নিষিদ্ধ। তাছাড়া পয়সা পাবো কোথায় যে সিনেমা দেখবো?
মামাকে সেদিন মনে হলো ভিন গ্রহের একজন মানুষ। মামা আমাকে সিনেমায় নিয়ে যাবে! সত্যি যাবেতো! কবে কখন তা আর জিজ্ঞেস করতে সাহস পাই না। যদি আমার স্বপ্নভঙ্গ হয়! সেদিন রাতে আমার আর ঘুম হয় না। তার পরের রাতেও না। মামাও কিছু বলে না। মামা ওইরকমই মানুষ। কোনো কিছুতেই মামা সরিয়িাস না। একটা কিছু প¬ান করলে তা সম্পাদন করতে অনন্তকাল কেটে যায় মামার। সেই মামা আমাকে সিনেমা দেখার স্বপ্ন দেখালো। সত্যি সত্যি আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে মামা একদিন সিনেমায় নিয়ে গেলো। আশ্চর্য্য আমার জীবনের প্রথম দেখা সিনেমাটার নাম আমি ভুলে গেছি। একদিন নিশ্চয়ই মনে পড়বে। তবে সম্ভবত সেটা সাত ভাই চম্পা, সুয়ো রানী দুয়ো রানী অথবা বড় বউ হবে।
সেই থেকে শুরু। ছোটমামা আজ আর নেই। কিন্তু তিনি যে বীজ ঢুকিয়ে দিয়ে গেছেন আমার মধ্যে তার প্রভাব যে এত তীব্র হবে তা কে জানতো। চোখের সামনে সারাক্ষন ঘুরে বেড়াচ্ছে রুপালী পর্দায় দেখা সেইসব স্বপ্নের মানুষেরা। কিছুতেই মাথা থেকে সরানো যায় না। আবার কবে যেতে পারবো? এক একটা সিনেমা মুক্তি পায়। আমার অদেখাই থেকে যায়। আমি বিষন্ন মনে ঘুরে বেড়াই। নিজেকে নিঃস্ব মনে হয়। পড়াশুনায় মন বসে না। আমি কেনো গেটম্যান হতে চেয়েছিলাম সেটা বলি। বিউটি সিনেমায় সাত্তার নামে একজন গেটম্যান ছিলেন। তার সাথে এক আধটু খাতির হলো। সে খেয়াল করে থাকবে আমি তার আশ পাশ দিয়ে ঘুরি। কিন্তু ভিতরে যাওয়ার পয়সা নাই। সে সদয় হয়ে মাঝে মাঝে পাঁচদশ মিনিটের জন্য আমাকে হলের ভিতরে ঢুকিয়ে দিত। ব্যস ওইটুকুই। তাতে আমার অতৃপ্তি আরো বাড়তো।
আমি আর আমার অকাল প্রয়াত ছোটবোন সাজু মিলে একবার ঠিক করলাম রাজ্জাক-ববিতার ’স্বরলিপি’ ছবিটা দেখতে যাবো। মাকে হাত পা ধরে রাজী করালাম। মা কিছু পয়সাও দিলেন। সেবার আমরা সিনেমা দেখে এসে বড় ভাইয়ের হাতে ধরা পড়ে গিয়েছিলাম। সে কাহিনী বড়ই বেদনার ছিল। কিন্তু আমি দমবার পাত্র নই। আমার সাহস বেড়ে যেতে থাকল। মা যা পয়সা দিত স্কুলে টিফিনের জন্য তা যথেষ্ট ছিল না সিনেমা দেখার জন্য। একবার গেলাম রাজ্জাক শাবানার ’প্রতিশোধ’ সিনেমাটা দেখতে। ঈদের ছবি। প্রচন্ড ভীড়। টিকেট ব¬্যাক হচ্ছে। আমার পকেটে আছে সাকুল্যে দু’টাকা। রিয়ার স্টল টিকেটের দাম হাঁকাচ্ছে আড়াই টাকা। কী করি। সিনেমা না দেখে ফিরে যাবো! নিরুপায় হয়ে একটা লোককে বললাম, ভাই আমাকে আট আনা পয়সা দেবেন? তাহলে আমি একটা টিকেট কিনতে পারি। সেই সদয় ব্যক্তিটিকে আমি আজও মনে করি। তার আট আনা পয়সা কোনোদিন ফেরত দেয়া হলো না!
আর একবার ঈদের সময় রাজ্জাক কবরীর ’ময়নামতি এবং ’নীল আকশের নীচে’ ছবি দুটো মুক্তি পেলো। পুরো রেজার মাস বরিশাল শহর জুড়ে ছবিদুটোর সে কী প্রচারনা। রাস্তায়, বাড়িতে, দেয়ালে সর্বত্র পোষ্টার আর লেখনী। সেবার স্কুল পালিয়ে প্রথম দেখলাম ’ময়নামতি’ ছবিটি, তার পরের শোতেই দেখলাম ’নীল আকাশের নীচে’। মনে আছে সেদিন খুব বৃষ্টি ছিল। রিক্সায় চড়ার পয়সা নাই। তাই করলাম কী রিক্সার পিছনে ঝুলে ঝুলে সিনেমা হল র্পযন্ত গিয়েছিলাম। সেদিন বাড়ি ফিরে মার হাতে ধরা পড়ে গেলাম। মনে আছে মা দুই হাত দড়ি দিয়ে বেধে পা আঙুলের উপর উঁচু করে দাড় করিয়ে শাস্তি দিয়েছিল। কিন্তু আমাকে কে দমায়?
এই গল্পটি আমি আগেও করেছি। তখন আমার বয়স তেরো/ চৌদ্দ হবে। বরিশালে বিউটি সিনেমা হলে তখন মর্নিং শো চলতো। শুক্রবার ছিল সেদিন। মর্নিং শোতে তখন সাধারণত: ইংরেজী ছবি চলতো। ছাবিটার নাম ছিল ’হানিমুন অফ দ্য টেরর’। পোষ্টাওে লেখা ছিল ‘শুধুমাত্র প্রাপ্ত বয়ষ্কদের জন্য’। ব্যস আর যায় কোথায়। লুকিয়ে লুকিয়ে টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম হলে। ডিসি ক্লাসে। তখনও ছবি শুরু হয়নি। আমার নির্ধারিত সীটে বসতে যাচ্ছি দেখি আমার আমার বড় ভাইও এসেছেন ছবি দেখতে। বড় ভাইকে আমরা যমের মতো ডড়াতাম, কারন তিনি খুবই কড়া প্রকৃতির মানুষ। আমি দ্রুত বের হয়ে এসে হলের নিচ তলায় রিয়ার স্টলের টিকেট কেটে ঢুকতে যাচ্ছি দেখি আমার মেঝ ভাইও ঢুকছেন। কি আর করা, অগত্যা সেদিন সিনেমা না দেখেই ফিরে আসতে হয়েছিল।
’রংবাজ’ ছবিটা দেখতে গিয়েছিলাম আমার বড় আপার সাথে। সেই ছবিতে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে একটা গান আছে। রাজ্জাক-কবরীর। ..হেই হেই রঙিলা রঙিলা রে..রিম ঝিম ঝিম বরষায় মন নিলা রে...আমি যে কী করি আহারে সুন্দরী..। এরপর তারা গাছের আড়ালে চলে যায়। শুধু পাগুলো বাইরে। দু’জনার পায়ের উপর পা.. ঘষাঘষি করছে, ভয়াবহ কিছু একটা হচ্ছে ওখানে। আমি দেখতে পাচ্ছিনা। বড় আপা খুব রাগ করেছিল সেদিন আমার উপর।
কবরী ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় নায়িকা। তখন আমি চিত্রালী পত্রিকাটা দেখি মাঝে মাঝে। কবরীর ছবি কেটে বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে রাখি। ববিতার জন্য আমার মন কেমন করে। আমি ভাবতাম একবার যদি ববিতার কাছে যেতে পারতাম! আমাকে যা করতে বলত আমি তাই করে দিতাম! এমনিক যদি আমি ববিতার বাড়ির বাগানের মালি হতেও পারতাম!! অথচ তখনও আমি ঢাকা শহরই দেখিনি! কবরীর হাসি আর ববিতার সৌন্দর্য্য আমাকে তাড়িয়ে বেড়াতো। খুব সঙ্গোপনে অনেক কল্পনার ভেলা ভাসাতাম। একটু বড় হয়ে প্রত্রিকায় চিঠিপত্র লেখা শুরু করলাম। কবরীর হাসি নিয়ে আমার প্রথম চিঠি ছাপা হলো চিত্রালীতে। তারপর আমি ক্রমাগত লিখে চলেছি।
সিনেমা দেখতাম আর ভাবতাম আমি কী কখনও নায়ক হতে পারবো! অনন্ত প্রেম ছবিতে রাজ্জাক নাকি ববিতাকে ছাপ্পান্নবার জড়িয়ে ধরেছিল! সেই ছবির জন্য শুনেছি চুম্বন দৃশ্যও গ্রহন করা হয়েছিল। কিন্তু ছবিতে তা দেখানো হয়নি। ইস! আমি যদি রাজ্জাক হতাম! তাহলে ’বাদী থেকে বেগম’ ছবির মতো নায়ক হতে পারতাম! সিনেমার পর্দায় আামাকে কেমন দেখাবে! আমি কী পারবো রাজ্জাকের মতো রোমান্টিক হতে! এসব ভেবে আমি শঙ্কিত হতাম। মনে আছে ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে অনেক ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ছিল। বার্ষিক স্পোর্টস ছাড়াও নাট্যানুষ্ঠান হতো। যাত্রাদলকে নিয়ে আসা হতো যাত্রাপালা করার জন্য। রাত জেগে যাত্রা দেখতাম আমরা। ’ইকবাল পাঠাগার এ্যান্ড ক্লাব’ ছিল একটা আমাদের। এই ক্লাবের উদ্যোগেই বার্ষিক নাটক হতো। মাসব্যাপী নাটকের রির্হাসাল চলতো। রিহার্সাল দেখতে দেখতে ডায়লগ মুখস্থ হয়ে যেতো। আমাদের কয়েকজনকে আশ্বাস দেয়া হলো ছোটো খাটো কোনো পাঠ দেয়া হবে। চা টা এগিয়ে দেয়া টাইপ কিছু। ওইটুক কিভাবে করবো এটা ভেবেই ভয়ে গা দিয়ে ঘাম ঝড়তো। যদিও শেষপর্যন্ত কখনও কোনো সুযোগ পাইনি।
তখনকার দিনে শনিবার তিনটায় এবং রবিবার সাড়ে তিনটায় আকাশ বানী থেকে নাটক হতো। এখনও হয়তো এ নিয়ম আছে। সিওর না। আমরা সবাই মিলে নাটক শুনতাম। নাটকের সাথে একাত্ম হয়ে যেতাম। হাসতাম, চোখে পানি চলে আসতো দুখের কিছু ঘটলে। ভাবতাম নিদেনপক্ষে রেডিওতে তো অভিনয় করতে পারি! কেউতো দেখবে না! আমার কন্ঠ কেমন শোনাবে! অনেক পরে যখন প্রথম রেডিও বা টেলিভিশনে ইন্টারভিউ দেই তখন দেখলাম আমার কন্ঠ কেমন মেয়েলি শোনায়। ভাগ্যিস আমি রেডিওতে নাটক করিনি!
তবে অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি বর্তমানে আমাকে ঢাকার বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখানো হচ্ছে। এবার ঢাকা গিয়ে আমি একটি এ্যাডে মডেল হয়েছিলাম। সেটাই দেখানো হচ্ছে। এমনকি সিনেমা হলেও দেখা যাচ্ছে। বিলবোর্ডেও নাকি আমার ছবি শোভা পাচ্ছে। আমি নিজে অবশ্য দেখিনি।
আমার নামকরন নিয়ে একটা ঘটনা আছে। সেটা বলি। তখন আমি মোটামুটি যুবক। বাড়ির পুকুরের টলটলে পানির দিকে তাকিয়ে থাকি। নিজেকে নিয়ে ভাবি। লুকিয়ে লুকিয়ে হাত দিয়ে নানা কায়দা করে চুলগুলোকে রাজ্জাকের মতো বানানোর চেষ্টা করি। গোসলের সময় ৫৭০ সাবান দিয়ে ডলে ডলে গায়ের ময়লা সাফ করি। অভিনয় যদি করি কতকী দরকার হবে! এদিকে চিত্রালী , পূর্বানী বা বেগম পত্রিকায় আমার চিঠিপত্র ছাপা হয় তখন।
চলচ্চিত্রের ’জসিম’ তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে অবস্থান করছে। কঠিন ভিলেন। দোস্ত দুশমন ছবিতে অভিনয় করে তার খ্যাতি চারিদিকে। শিরীন নামে বড় আপার একজন বন্ধু ছিল। চিত্রালীতে তিনি আমার চিঠি পড়েছেন। চিপাচস করতেন বরিশালে। যখন বড়আপার কাছে শুনলেন আমি তার ভাই, তিনি আপাকে জিজ্ঞেস করলেন, ’আপনার ভাইয়ের কয় ছেলে মেয়ে! বয়স কত! অনেক মোটা সোটা’! বড়আপা হেসে বললেন, ’আরে না, মাত্র সতেরো চলছে। আমার ভাই মোটেই গাব্দা গোব্দা না। একদম পাঠকাঠির মতো’। আমি তখন খুউব চিকন চাকন ছিলাম। এখনও। এই কথা শুনে শিরীন আপা খুব হতাশ হলেন! জসিমের জনপ্রিয়তার কারনেই ওই নামের যে কাউকেই লোকে দাঙ্গাবাজ আর ভুঁড়িওয়ালা মনে করতো। উল্লেখ্য আমার নাম বড় আপাই রেখেছিল। কবি জসিম উদ্দিনের নকশি কাঁথার মাঠ দেখেই নাকি এই নামকরন। শিরীন আপার সাথে পরবর্তীকালে আমার যোগাযোগ হয়েছিল। আমিও তার সাথে কিছুদিন চিপাচস করেছি।
চলে আসলাম ঢাকায়। ভর্তি হলাম ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে। মহসিন হলের ৪৬২ নম্বর কক্ষে উঠলাম। রুমটা ছিল জাসদের ক্যাডারদের। ওখানে টিকতে পারলাম না। এমন সময় খায়রুজ্জামান কামাল আমাকে নিয়ে গেলো তার ৬৩২ নম্বর রুমে। সে তখন এরশাদের দৈনিক জনতার বিশ্বদ্যিালয় রিপোর্টার। বেশ দাপট। আমি কঠিন সময় পার করছি। পকেট হাহাকার করছে। বিচিত্রার আশপাশ দিয়ে ঘুরি। ভিতরে প্রবেশের সাহস পাই না। এমন সময় পরিচয় হলো কেজি মোস্তফার সাথে। তিনি তখন ডিএফপি থেকে প্রকাশিত সচিত্র বাংলাাদেশের সম্পাদক। তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে কিছু কাজ দিলেন। সেটা হচ্ছে পুরনো দিনের অভিনেতাদের সাক্ষাৎকার নেয়া। আমি কোনোদিন সাংবাদিকতা করিনি। ভাবলাম পারবোতো! চলচ্চিত্রের লোকদেও সামনা সামনি দেখবো! আমি রেমাাঞ্চিত হলাম!
লেগে গেলাম কাজে। আমার পয়সা দরকার। প্রথম ইন্টারভিউ করলাম বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র ’মুখ ও মুখোশ’ ছবির পরিচালক আবদুল জব্বার খানের। আমাকে আশ্চর্য্য করে দিয়ে ছাপা হলো ইন্টারভিউ। এরপর আমি পর্যায়ক্রমে আনোয়ার হোসেন, গোলাম মোস্তফা, সুমিতা দেবী, রানী সরকার প্রমূখের ইন্টাারভিউ করলাম। সূর্য দীঘল বাড়ির পরিচালক শেখ নিয়ামত আলীরও ইন্টারিভিউ করেছিলাম। আজ এদের কেউই প্রায় বেঁচে নেই। সুমিতা দেবী আর রানী সরকারের শেষ জীবন ছিল খুবই দুর্বিসহ। একটা ঘটনা বলি। আমি তখন মুন্নু গ্রুপের জনসংযোগ কর্মকর্তা। একদিন অফিসে বসে আছি। আমার কক্ষে প্রবেশ করলেন রানী সরকার। গুরুতর অসুস্থ। চিকিৎসার পয়সা নেই। এসেছেন সাহয্যের জন্য। সেদিন আমি তাকে বলিনি যে একদিন তার ইন্টারভিউ করেছিলাম। তার জন্য অমি কষ্ট পেয়েছিলাম।
১৯৮৪ সালে বিচিত্রায় কাজ করার সুযোগ মিলল। বিচিত্রা হচ্ছে দৈনিকবাংলা ট্রাষ্টের পত্রিকা। দৈনিকবাংলায় তখন ছায়ামঞ্চ নামে একটি বিভাগ ছিল। সেখানে চলচ্চিত্রের খবর ছাপা হতো। পাতাটি দেখতেন রেজোয়ান সিদ্দিকী। চলচ্চিত্রের প্রতি আমার উৎসাহ এবং সচিত্র বাংলাদেশে কাজ করেছি শুনে আমাকে কাজ দিলেন প্রতি সপ্তাহে সিনেমা দেখে তার রিভিউ লেখা এবং এফডিসিতে গিয়ে খবরা খবর সংগ্রহ করা। আমি বরিশালে থাকতেই মাঝ মাঝে চিত্রালীতে আপনাদের পাতায় সিনেমা নিয়ে লিখতাম। প্রায়ই বিচিত্রার মাহমুদা চৌধুরীর চলচ্চিত্র সমালোচনা থেকে মেরে দিতাম। একবার একজন পাঠকের কাছে ধরা পড়ে গেলাম। সে আমার চুরির কথা লিখল চিত্রালীতে। সেই থেকে অন্যের লেখা মারা বন্ধ।
একবার এফডিসিতে গেলাম। গিয়ে দেখি নায়ক উজ্জলের একটা মারদাঙ্গা ছবির সুটিং চলছে। উজ্জল তখন মোটামুটি মেগাস্টার। আমি সাংবাদিক। আমার আবার ভয় কি! ঢুকে পড়লাম সেটের ভিতর। সুটিং বন্ধ! উজ্জল ক্ষেেপ গিয়ে আমাকে সেট থেকে বের করে দিলেন। এবং দৈনিক বাংলায় আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন। আর একবার গেলাম এফডিসির পিআরও গুলরুখ আপার কাছে। তিনি হচ্ছেন সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনের বোন। গিয়েই সরাসরি বললাম, “এফডিসিতে কী কী দূর্নীতি হয় বলেন।” তিনি হেসে বললেন, “আমি পিআরও। আমি কী আপনাকে বলবো যে এখানে দূর্নীতি হয়!” অনেক পরে প্রেসক্লাবে যখনই তার সাথে দেখা হতো এই ঘটনা নিয়ে হাসাহাসি করতেন!
চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা খতম। শুরু হলো সিনেমা দেখা। প্রতি সপ্তাহে একটা করে সিনেমা দেখি। তখন থেকেই বাংলা সিনেমার অধঃপতন শুরু হয়েছে। রেজিনা আর অঞ্জু ঘোষের বুক থ্রো হিপ থ্রো ছবি আর ’ও ছেরি তোর বুকে দ্ইুটা জাম্বুরা’ টাইপ গান শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে ইস্তফা দিলাম ছবি রিভিউ লেখার।