Table of Content

Rina Gulshanara
NA
NA
5 articles

সুখীর সুখ

লেখক: রীনা গুলশানারা Category: ছোট গল্প (Short Story) Edition: Dhaboman - Eid 2017

 

“কলিমুদ্দিন চাচা বাড়ি আছো নি?”

সবে মাত্র খাবার পালা চুকিয়ে রোজকার মত মাটিতে চাটাইয়ের উপর একটু গড়িয়ে নিচ্ছিল সুখী। তন্দ্রার আমেজে চোখের পাতা মুদে আসার আগেই একটা ভরাট কন্ঠের ডাকাডাকিতে ধড়ফড় করে উঠে বসল এবং তারপর বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে উঠল। বক্কার ব্যাপারী। এই আরেক আপদ। কিন্তু সুখী বুঝতে পারছে, এর হাত থেকে তার বোধহয় অব্যহতি নেই। বাজানের ভাবসাবও ভালো লাগছে না।

“কি অইলো, এই দিনের বেলা হগলে ঘুমাইতাছেন নি? এমুন কইরা ডাকতাছি হ্যার পরও সাড়া নাই ক্যান?”

প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে সুখীকে উঠতে হল। কপাটের আড়াল থেকে বলল, “বাজানের এই হপ্তায় দুফুরে রিক্সা চালাইতে হইব। এহনেই মহাজনের কাছে গেলোগা।”

“তাই নাহি? আমি হেইডা জানতাম না। তাইলে আর কি করন যায়...তোমার বাজানের লগে একটা জরুরী আলাপ আছিল। হ্যার লাইগাই এই রোদ্দুর মাথায় কইরা আইতে হইল। ...গলাডা এক্কেরে হুগাইয়া কাঠ হইয়া গ্যাছে...তা এক গ্লাশ পানি দিবানি?”

হুহ! জানত না আবার! ঠিগই জানে বাজানের দুফুরে রিক্সা চালাইবার কথা...আর এই সময়ডাই ঐ বেলাজ ব্যাডার আসন চাই। আর আইসাই হাজার বছরের পানির তেষ্টায় তার গলাডা হুগাইয়া কাড হইবো। --আহঃ মরণ – ব্যাডা মরেও না। বেহায়া বেলাজ! মনে মনে গজ গজ করতে করতে একটা কাঁচের গ্লাশে কানায় কানায় ভর্তি করে পানি দেয় বক্কার ব্যাপারীকে। পানি খেয়ে তৃপ্তিতে নিঃশ্বাস নিয়ে, মুগ্ধ বিহবিল বক্কার ব্যাপারী বার কয়েক সুখীকে দেখে মৃদু গলায় বলে, “তাইলে আমি যাই। তোমার বাজানে আইলে কইও আমি আইছিলাম।”

সুখী কোনরকমে হ্যাঁ বলে দরজার খিল তুলে দিয়ে আবার চাটাইয়ের উপর গড়িয়ে পড়ল। যেন কত রাজ্যের ক্লান্তি আর অবসন্নতায় সুখীর দেহ মনে ভীড় করেছে। সুখী এখন ভীষণ একা। গত বছরেই ওর একমাত্র আপনজন “নানো” তার আদরের নাতীন সুখীকে ছেড়ে মাটির নীচে শেষ আশ্রয় নিয়েছে। জন্ম অবধি ও ওর নানোর কাছেই মানুষ। ওকে পৃথিবীর আলো দেখার সুযোগ করে দিয়েই ওর মা ছুটি নিয়েছিলেন। কিন্তু ওর বাজানে আর দ্বিতীয়বারের মত নিকা করে নাই। সেই কচি শিশুকে বুকে নিয়ে আদরে আদরে ভরে দিয়ে সজল চোখে ওর নানোর কাছে বলেছে, “এই আমার সুখী। জমিলা আমারে ছাইড়া চইলা গেছে, কিন্তু জমিলার জায়গায় আমি আর কারেও আনতে পারুম না।”

সেই থেকে সুখী ওর নানোর কাছেই মানুষ। ওর বাজান ঢাকার কোন এক বস্তির একটা ঘরে ঠাই নিয়ে কোন রকমে থাকে। দিনের বেলা মহাজনের কাছ থেকে রিক্সা নিয়ে চালায়। খাওয়া ফুটপাথের হোটেলেই সারে। আর দুই তিন মাস বাদে এটা সেটা কিনে তার অন্ধের ষষ্ঠী সুখীকে দেখতে আসে। সুখীর তখনকার সময়গুলো ভালোই কাটত। জন্মাবধি মাকে হারালেও নানোর স্নেহ আর বাজানের আদরে সেই অভাব ভুলে গিয়েছিল। আর ওর সমস্ত স্বত্বা জুড়ে ছিল আর একটা অস্তিত্ব – রহম আলী। চকচকে কালো পেটা শরীরের রহম আলী যেন ছিল সুখীর সমস্ত সুখের উৎস। সাঁঝের একটু আগে নিত্য দিনের মত নদীতে যেত এক কলস পানি আনতে। যাবার আগে ঘরের খিল তুলে দিয়ে মনের মত সেজে নিত। তোরঙ্গে তোলা কাঁচা পরিষ্কার রঙচঙে ছাপা শাড়ী, ঠোঁটে আলতার রঙ, চোখে কাজল, কপালে কাঁচ টিপ। জানতো নদীতে যাবার পথে তেতুল গাছের নীচে রহম আলী দাঁড়িয়ে থাকবে ওর অপেক্ষায়। তাকে দেখলেই রোজকার মত গদ গদ কন্ঠে বলবে, “সুখীরে, এমুন দেরী হইল ক্যান?”

সুখী ঠোঁট টিপে সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে বলবে, “আমি কি তোমার লাহান পুরুষ মানুষ নাহি? মাইয়া মানুষের কত্ত কাম...আইতে হের লাইগ্যা তো দেরী হইবই।”

তারপর ওরা দু’জন তেতুল গাছ ছাড়িয়ে নদীর কোল ঘেঁষে বসবে অজস্র না বলা কথার মালা নিয়ে। কোন দিন ওরা দু’জনে হয়ত কোন কথাই বলবে না। শুধু দু’চোখের আকুল তৃষ্ণা নিয়ে দু’জনে দু’জনাকে দেখবে। ওদের এই গোপন ভালোবাসার কথা নানো ছাড়া কেউ জানত না। নানো গোপনে এই ইচ্ছাই লালন করত ... রহম আলী হবে নাত জামাই।

কিন্তু কেমন কর যেন সমস্ত কথা জানতে পারে রহম আলীর পালন কর্তারা। মা বাপ মরা এতিম রহম আলীর চাচা-চাচীর কাছে এই সংবাদ কোন ক্রমেই সুখবর ছিল না। তাদের একান্ত ইচ্ছা অবশ্য রহম আলী নিজেও জানত। তাদের একমাত্র মেয়ে ফুলবাণু -যার এক চোখ অন্ধ। রহম আলীর সাথে তার বিয়ে দিতে চাইতেন চাচা-চাচী। রাজকন্যা এবং রাজত্ব। কিন্তু রহম আলীর এই ব্যাপারে ঘোর অমত ছিল। চাচা-চাচীর প্রতি কৃতজ্ঞতা থাকলেও নিজের ভালোবাসাকে জলাঞ্জলি দেবার মত মানসিকতা তার ছিল না। কিন্তু এত সুখ বোধহয় সুখীর ভাগ্যে লেখা ছিল না। ওর সীমিত সাজানো জীবনে একটা সাঙ্ঘাতিক পরিবর্তন এলো বড় আকস্মিক ভাবে।

একদিন, রোজকার মত নদীর ঘাটে পানি আনবার পথে সুখী দেখল, তার ভালোবাসার মানুষটা তেতুল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে নেই। ভীষণ অবাক হলেও গুরুত্ব দেবার মত কিছু মনে হয় নি। কিন্তু পরপর চার দিন যখন সেই মানুষটার  দেখা পেল না তখন বুঝল সমস্যা কিছু একটা হয়েছে। কয়েক দিন বাদে থমথমে মুখে রহম আলী একেবারে সুখীদের বাসায় এসে হাজির। সেই দিনই আদ্যোপান্ত সমস্ত ব্যাপার জানল সুখী। বড় চাল চেলেছে রহম আলীর চাচা করিম শেখ। নগদ টাকার বিনিময়ে ভাতিজাকে কাঁচা মালের ব্যাবসায়ে নামিয়ে দিয়েছে। টাকার অংকটা ওদের মত গরীবের কাছে নিতান্ত কম নয়। প্রথম বারেই সাত হাজার। পরে নাকি আরোও পাবার আশা আছে। বৃদ্ধ বয়েসে আর পেরে উঠছে না তাই সংসারের হাল রহম আলীই ধরুক, এটাই তার ইচ্ছা। এবার আর রহম আলী তাদের ইচ্ছায় বাঁধ সাধতে পারেনি। চাচা-চাচীকে সে আর কষ্ট দিতে চায় নি। কিন্তু তার মনের এই পরিবর্তনের কারণ সুখী বুঝতে পেরেছে। রহম আলীর মুখ থকে শুনতে হয়েছে “জীবনে বাঁচতে অইলে ট্যাকার দরকার। বালোবাসা লইয়া তো জীবন চলবো না, এইডাই ভালো অইল সুখী...তুই আমারে ভুইলা যাস...তাছাড়া এক চক্ষু আন্ধা অইলেও ফুলিরে দ্যাখতে অত খারাপ না...তরেও কই, তোর বাজানে যেহানে বিয়া দ্যায়...হেইহানে অমত করিস না।”

 

ইস! বেলা এক্কেবারে পইড়া গেল। কত্ত কাম পইড়া রইছে আর আমি এইহানে শুইয়া শুইয়া চিন্তা করতাছি! নিজের উপরেই বিরক্ত সুখী ধড়ফড় করে উঠে পড়ল। বাজানে একটু পরেই আসবে। তার আগেই ওর রান্না সারতে হবে। ঘর দোর সাফ করে নিজেকে কিছুটা পরিপাটি করে গলির মাথায় যেয়ে খাবার পানির লাইনে দাঁড়াতে হবে। ঘর ঝাঁটা দিতে দিতে হঠাৎ গতকাল ঘুমাবার আগে বলা বাজানের কতগুলো কথা মনে পড়ল। “সুখী, মা আমার, এবারে আর অমত করিস না। তরে সুখী না দেইখা আমি তো মরলেও শান্তি পামু না।ওরে হাতের পাঁচটা আঙ্গুল সমান যায় না। বক্কার ব্যাপারী শুধু তোরেই চায়...সাথে টেকা চায়না...। রহম আলীর ভালোবাসা দিয়া পৃথিবীর হগলের ভালোবাসা বিচার করিস না।”

অনেক দিন বাদে নিজেকে সুখী আবার আগের মত পরিপাটি করে সাজিয়ে কলস নিয়ে পানির জন্য লাইনে গিয়ে দাঁড়াল। রহম আলীর সাথে বিচ্ছেদের কিছুকাল পরেই বাজানের সাথে ও শহরে চলে এসেছিল। নানোও বোধহয়  সুখীর এই দুঃখ সহজে মেনে নিতে পারেনি। রহম আলীর আর ফুলবাণুর বিয়ের মাত্র তিন মাস পরেই নানো মারা যায় - নিঃশব্দে, নীরবে, ঘুমের মধ্যে। তারপরই বাজান ঢাকার বস্তীতে সুখীকে নিয়ে এলো। আজ এতোকাল পর (রহম আলির বিশ্বাসঘাতকতার পর প্রায় দুই বছর পেরিয়ে গেছে) সুখী যেন হঠাৎ করে নিজেকে ফিরে পেল। ওর বাজানের ক্রমাগত দুঃখী মুখ হঠাৎ করেই যেন সুখীর সমস্ত অস্তিত্বকে নাড়া দিয়ে যায়। এ সে কি করছে? রহম আলীর উপর রাগ করে ব্যাপারীকে দূরে সরিয়ে রেখে কি লাভ? তার বাজানের মনে কষ্ট দিচ্ছে সে। রহম আলী অর্থের কারণে তার ভালোবাসাকে পদাঘাত করেছে, কিন্তু বক্কার ব্যাপারী  তার মত নয়। সে অর্থ চায় না, শুধু সুখীকেই চায়। ওকে এক পলক দেখবার জন্য কত ছল করে। এই সাঁঝের বেলায় হঠাৎ করে বক্কার ব্যাপারীর মুগ্ধ দৃষ্টির কথা মনে করে নিজ হৃদয়ের গহীনে এক লালিম অনুভূতি আবিষ্কার করে সুখী। আজ বাজান ফিরে এলে সে তার সম্মতি দেবে। এক নতুন স্বপ্নের কাঁথা বুনতে বুনতে সে তার বাবার ফিরে আসবার জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকে।